মাটি ছাড়াই ফুল-ফল সবজি চাষ

মাটি ছাড়াই ফুল-ফল সবজি চাষ
দেশে জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। শহর-নগর-বন্দরে এখন এক চিলতে জায়গা খুঁজে পাওয়াই দায়। মাটি তাই রত্নের চেয়েও দামি। সেই মাটি দিয়ে ছাদের ওপর এক ফালি শখের বাগান গড়ে তোলেন অনেক শহুরে। কেউ বা বেলকনি বা বারান্দার কোণে গোটাকয়েক ফুলের টব বসিয়ে দেন। কিন্তু মাটি ছাড়াও ফুল, ফল ও সবজির চাষ সম্ভব। স্রেফ পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে সম্প্রতি সাফল্য পেয়েছেন গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের কৃষিবিজ্ঞানীরা।

পানিতে চাষাবাদের কেতাবি নাম ‘হাইড্রোপনিক পদ্ধতি’।

নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে সবজি, ফল ও ফুল উত্পাদনের এটি একটি কৌশল। এই পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উত্পাদন সম্ভব। এতে ফসলের রোগবালাই কম হয় এবং কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয় না। শহরে যাঁরা বাস করেন, এই পদ্ধতিতে চাষবাসে তাঁরাই বেশি সুফল পাবেন।

এ পদ্ধতিতে কৃষিবিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত স্ট্রবেরি, টমেটো, বেগুন, শসা, মরিচ, সিম, খিরা, লেটুস পাতা, ক্যাপসিকাম, গাঁদা ফুল, চন্দ্রমল্লিকা, ধার বেড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ব্রোকলির ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সাফল্য পেয়েছেন।

যেভাবে শুরু করতে হবে: সাধারণত দুটি উপায়ে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়। প্রথমত, সঞ্চালন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানগুলো যথাযথ মাত্রায় মিশিয়ে একটি ট্যাঙ্কে নেওয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উত্পাদন করা হয়। প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। দ্বিতীয়ত, সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উত্পাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো পাম্প ছাড়াই খাদ্য উপাদানমিশ্রিত দ্রবণ একটি পাত্রে নিয়ে এর ওপর একটি কর্কশিট দেওয়া হয়। দ্রবণ থেকে কর্কশিট পাঁচ-সাত সেন্টিমিটার ওপর থাকবে। কর্কশিটে চার-পাঁচটি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে, যাতে বাতাস ঢুকতে পারে। এ পদ্ধতিতে বাড়ির ছাদ, বারান্দা ও খোলা জায়গায় প্লাস্টিকের বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিলে সহজেই সবজি ও ফুল উত্পাদন করা যাবে।

১০০ লিটার পানিতে এক লিটার দ্রবণ মেশাতে হবে। চারা রোপণের এক মাস পর পাত্রে দ্রবণের পরিমাণ কমে গেলে যে পরিমাণ দ্রবণ কমবে ঠিক সেই পরিমাণ দ্রবণ ফের দিতে হবে।

খাদ্যদ্রবণ তৈরির প্রক্রিয়া:
প্রতি ১০০ লিটার পানিতে পটাসিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এক কেজি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ছয় দশমিক ১০ গ্রাম, বরিক এসিড এক দশমিক ৮০ গ্রাম, কপার সালফেট দশমিক ৪০ গ্রাম, অ্যামোনিয়াম মলিবডেট দশমিক ৩৮ গ্রাম, জিংক সালফেট দশমিক ৪৪ গ্রাম মেশাতে হবে।

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে টমেটো চাষ:
অক্টোবরের মাঝামাঝি টমেটোর চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। চারার বয়স যখন তিন-চার সপ্তাহ বা চারায় যখন দুই-তিনটি পাতা আসে তখন সেটি রোপণ করতে হবে। কর্কশিটের ওপর ছিদ্র দিয়ে চারার শিকড় দ্রবণ পর্যন্ত ছোঁয়াতে হবে। ওপর থেকে সুতা বা রশি দিয়ে গাছকে সোজা ও খাড়া রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি টমেটোর ওজন হবে ১৫০-২০০ গ্রাম। একটি গাছে আড়াই থেকে পাঁচ কেজি টমেটো ধরে।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এম আলতাব হোসেন বলেন, ‘এর আগেও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা হয়ছে। তবে গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এর সফলতা পেয়েছেন।’

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. ইউসুফ মিঞা বলেন, ‘যাঁরা শহরে বাস করেন এবং চাষাবাদে আগ্রহী তাঁরা এ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা বেশি করে করতে হয় এবং খরচ একটু বেশি।’