সৌরবিদ্যুৎ কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে

প্রতিবছর বোরো মৌসুম এলেই সেচ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা করতে হতো কৃষককে। বিদ্যুৎ-সংকট, লোডশেডিং, লো ভোল্টেজ ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁরা কখনোই নিরবচ্ছিন্ন সেচসুবিধা পাননি। সেচ নিয়ে দুশ্চিন্তা আর ভোগান্তি প্রায় নিয়তিতেপরিণত হয়েছিল।
তিন বছর আগে কৃষককে যখন জানানো হলো সেচের জন্য বিদ্যুৎ আর ডিজেলের পেছনে ছুটতে হবে না। তখন অনেকেরই তা বিশ্বাসহয়নি। জমিতে সেচ দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই তাঁরা দেখল সূর্যের আলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকেই জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে। লোডশেডিং কিংবা লো ভোল্টেজের কারণে পাম্প বন্ধ থাকার মতো ঘটনা আর ঘটছে না।
সূর্যের আলোয় চলছে সেচপাম্প। এতে বদলে গেছে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার আট গ্রাম। খরা মৌসুমেও সেচের পানি নিয়ে ভাবনা নেই কৃষকের। ওই অঞ্চলে কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলেছে সৌর সেচ


কৃষকদের সেচসুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পাঁচ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে বোদা উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউয়িনে আটটি, মাড়েয়ায় দুটি, সদর উপজেলার নাককাটি ও খোলাপাড়ায় দুটি সৌর সেচপাম্প স্থাপন করে। ২০১০-১১ সালে দুটি প্রকল্প স্থাপনের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ১০ বছর কৃষকেরা নির্ধারিত হারে সেচের মূল্য প্রদান করবেন। ১০ বছর পরে সোলার প্যানেলটির মালিক হবেন প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের নিয়ে গঠিত সমিতির সদস্যরা।
কৃষকদের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে সেচসুবিধা দেওয়া, বছরে কমপক্ষে তিনটি ফসল উৎপাদনে সহযোগিতা করা, বিদ্যুৎ-সংকট সমাধানে সহযোগিতা, নবায়নযোগ্য ও কার্বন নিঃসরণবিহীন শক্তি উৎপাদন করে জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে সহায়তা করা এবং বছরব্যাপী নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ন্যূনতম সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যেই ওই প্রকল্প নেওয়া হয়।

বোদা উপজেলার জগন্নাথপাড়া ও শিকারপুর গ্রামের অনেক কৃষক আগে সেচের অভাবে জমি ফেলে রাখতেন। এ সমস্যা সমাধানে এবং প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুই গ্রামের ৬০ জন কৃষক নিয়ে জগন্নাথপাড়া/শিকারপুর আদর্শ কৃষক সমিতিগঠন করা হয়। অন্য ছয়টি গ্রামেও একইভাবে কৃষকদের নিয়ে সমিতি করা হয়।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ১০০ বিঘা জমি সেচের আওতায় এসেছে। পাঁচ হাজার টাকায় এক বিঘা জমিতে সারা বছর এ প্রকল্প থেকে সেচসুবিধা পাওয়া যায়।

প্রকল্পভুক্ত শিকারপুর গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সৌরবিদ্যুৎ আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
কৃষক নুরন নবী বলেন, বিদ্যুৎ আর ডিজেলের ঝামেলা নেই। সূর্যের আলো হলেই চলে।

পহিরউদ্দিন বলেন, এক একর জমির বোরো খেতে প্রতি সেচে একজন কৃষকের ডিজেলে খরচ লাগে ১০-১২ হাজার টাকা। সেখানে সৌরবিদ্যুতে মাত্র নয় হাজার টাকা লাগে।


মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রকল্প সমন্বয়কারী জয়নুল আবেদীন বলেন, বোদা ও সদর উপজেলার ১৬টি প্ল্যান্টে ৫১২টি সৌর প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে। এসব প্যানেল সরাসরি সূর্য থেকে তাপ শোষণ করে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ বিদ্যুৎ দিয়ে পাম্পের সাহায্যে ছয় ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মাধ্যমে পানি তুলে সেচ দেওয়া হয়। সৌরবিদ্যুতের এই প্যানেলে কোনো ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়নি। দিনের আলো যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ এই প্ল্যান্ট সচল থাকবে। আর প্রতিটিতে ঘণ্টায় ৮০ হাজার লিটার পানি তুলে তা সেচের কাজে ব্যবহার করা যাবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এসএমই প্রধান মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘এ অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা একরকম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। প্রাথমিকভাবে দুটি গ্রামে ২০১০-১১ সালে তিনটি প্রকল্প স্থাপন করি। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে আমরা এ প্রকল্প স্থাপন করি। পরে আরও ১৩টি প্রকল্প স্থাপন করা হয়। ভবিষ্যতে তা আরও সম্প্রসারণের চিন্তা রয়েছে।

এলাকার কৃষকেরা জানান, যুগ যুগ ধরে জমিতে একটিমাত্র ফসল উৎপাদন করা হতো। আমন ফসল উঠে যাওয়ার পর সেচের অভাবে বছরের প্রায় সাত মাস জমি অলস পড়ে থাকত। এখন সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে বোরোর আবাদ করছেন তাঁরা। শীতকালীন শাকসবজির চাষও হচ্ছে।