বাংলাদেশে ধান চাষে বহুল আলোচিত ম্যাজিক
গ্রোথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শত শত কৃষক, কৃষিবিদ ও গবেষক সফল হয়েছেন। তারা ইউরিয়া সারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়েও
ধান অধিক উৎপাদন করে লাভবান হয়েছেন বলে জানা গেছে। বর্তমান সময়ে দেশের কৃষিক্ষেত্রে
বহুল আলোচিত ধান চাষের ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তির গবেষণা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের
খামারেও করা হচ্ছে। প্রযুক্তিটির উদ্ভাবক বিএডিসির বীজ বিপণন বিভাগের রাজশাহী বিভাগীয়
যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আরিফ হোসেন খান আশা করছেন ব্র্রির এ গবেষণার মাধ্যমে ধানগাছে
পাতার মাধ্যমে ইউরিয়াসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে এবং ধান চাষের প্রয়োজনীয়
ইউরিয়া সার শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়েও বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব। কৃষিবিদ মোঃ আরিফ হোসেন
খান পাতার মাধ্যমে গাছকে খাদ্য প্রদানের এ বিষয়টি নিয়ে চাকরির পাশাপাশি শৌখিনভাবে
দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে গবেষণা করছেন। তবে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ক্ষমতায় আসার পর এরই
মধ্যে তিনি তার এ গবেষণা কাজটি সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক দেশের ৬৪টি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ
অধিদফতরের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বিভিন্ন খামারে
এবং দেশের অধিকাংশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্লটে ধান উৎপাদনে ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তির
পরীক্ষা করে সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেছে। প্রত্যেক জমিতেই দেখা গেছে যে, ধান চাষে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সারের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কমিয়েও
বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানের মাঠ পর্যায়ে ফলন শতকরা
২০ ভাগ পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায়। তিনি জানান, তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তির বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় অবহিত রয়েছে এবং এ মন্ত্রণালয়ের
সচিব ড. এমএম নাজমুল ইসলামের সরাসরি নিদের্শনা মোতাবেক উদ্ভাবকসহ ব্রির বিভিন্ন বিভাগের
ছয়জন গবেষকের সমন্বয়ে গবেষণাটি করা হচ্ছে। গবেষণাটি কয়েক মৌসুমে হবে। তবে প্রথম মৌসুমের
গবেষণাতে শতকরা ৪০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করেও যে বেশি ধান উৎপাদন সম্ভব হবে সে বিষয়টি
প্রতিষ্ঠিত হবে বলে গবেষক কৃষিবিদ আরিফ খান আশা করছেন।
তিনি জানান, তার উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের গভর্নেন্স
ইনোভেশন ইউনিট থেকে জাতীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উদ্ভাবিত ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তির
মাধ্যমে কেন শতকরা ৪০ ভাগ ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে
সে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি জানান, ধান চাষের ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তি মূলত একটি কৌশল, এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সারের শতকরা ৫০ ভাগ দুইবারে মাটিতে
প্রদান করে ধানগাছের পর্যাপ্ত পাতা তৈরি করে নেয়া হয়। এরপর ম্যাজিক গ্রোথের (গবেষক
কর্তৃক উদ্ভাবিত উদ্ভিদের ১৩টি অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পুষ্টি উপাদান এবং কিছু বেনিফিসিয়ারি
উপাদানে সমৃৃদ্ধ একটি মিশ্র তরল সার) সঙ্গে শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ ইউরিয়া এবং প্রতি
লিটার পানিতে ১০ গ্রাম (১% দ্রবণ) পটাস সার মিশিয়ে তিনবার স্প্রে করা হয়। ইউরিয়া সার
মাটিতে দিলে শতকরা ৭০ ভাগ অপচয় হয় এবং পাতায় দিলে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি কাজে লাগে। এছাড়াও
এক কেজি ইউরিয়া সার পাতায় প্রয়োগ করলে মাটিতে চার কেজি ইউরিয়ার সমান কাজ করে। এজন্য
ধানগাছের পর্যাপ্ত পাতা তৈরির পর শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ ইউরিয়া পাতার মাধ্যমে প্রয়োগ
করে অবশিষ্ট শতকরা ৫০ ভাগ ইউরিয়া প্রতিস্থাপন করা যায় অর্থাৎ এ প্রযুক্তিতে ইউরিয়া
সারের অপচয় রোধ এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। আর ফলন বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, চাষি আজকাল জমিতে কোনোরকম জৈব সার ব্যবহার না করেই বছরের পর
বছর রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল ফসলের চাষাবাদ করছেন। ফলে
প্রতিনিয়ত জমির অত্যাশ্যকীয় অনু পুষ্টি উপাদানসহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান কমে যাচ্ছে, জমির অনুজীব কমে যাওয়ায় প্রয়োগকৃত রাসায়নিক সার গাছের জন্য সহজে
গ্রহণযোগ্য অবস্থায় আসতে পারছে না। এছাড়াও মাটির পিএইচ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতাসহ নানাবিধ
সমস্যার ফলে গাছ মাটি থেকে সঠিকভাবে পুষ্টি গ্রহণ করতে না পারার কারণে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে
এবং সঠিকভাবে ফলন দিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে ম্যাজিক গ্রোথের মধ্যেও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসহ
বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান পাতার মাধ্যমে গাছে প্রবেশ করায় গাছকে অধিক সুস্থ এবং সবল করে
তোলায় গাছ কাঙ্ক্ষিত ফলন দিচ্ছে। ম্যাজিক গ্রোথ গাছের জন্য একটি টনিক বা হেলথ ড্রিঙ্কস
হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান সময়ে দেশের মাটির যে অবস্থা তাতে করে বেশি ফলন পেতে হলে এমন
তরল সার বা গাছের জন্য তরল পুষ্টির ব্যবহার অতি আবশ্যক। ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তিটি
শুধু ধানে নয়, সব কৃষি ফসলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
বিভিন্ন সবজি ফসলে আরও বেশিমাত্রায় কার্যকর।
তিনি আরও বলেন, ইউরিয়া সারের কৃত্রিম সঙ্কটকালীন সমস্যা মোকাবিলায় পাতার মাধ্যমে
নাইট্রোজেন প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। চাষি কখনও সার ব্যবসায়ীদের
কাছে জিম্মি হবেন না। যেমন যদি কোনো চাষির ধানের জমিতে প্রদানের জন্য ২০ কেজি ইউরিয়া
সারের প্রয়োজন হয়। তবে তিনি দুই থেকে তিন কেজি ইউরিয়া সার পাতার মাধ্যমে প্রয়োগ করে
তার ফসলকে অন্তত সাত থেকে আট দিন সুরক্ষা দিতে পারবেন। এছাড়া ম্যাজিক গ্রোথ প্রযুক্তির
ব্যবহার আমাদের মাটির স্বাস্থ্য, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, প্রাকৃতিক গ্যাস সাশ্রয়, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, নতুন শিল্পের বিকাশ
ও অধিক মানুষের কর্মসংস্থান, ইউরিয়া সারের সংরক্ষণ
ও পরিবহন জটিলতা হ্রাস এবং ফসলের অধিক উপাদনের মাধ্যমে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে অধিকতর
সুরক্ষা দেবে।
তিনি আরও বলেন, ধান চাষে শতকরা ৪০ ভাগ ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে বেশি ধান
উৎপাদনের মতো গবেষণার সাফল্য বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পরিম-লে আজ পর্যন্ত কেউ উদ্ভাবন
করেছেন বলে তিনি জানেন না। গবেষণাগার থেকে কৃষকের মাঠে এমন লাগসই ও সহজ প্রযুক্তি শুধু
বাংলাদেশ নয়, একসময় হয়তো বিশ্বের অন্যান্য ধান উৎপাদনকারী
দেশের জন্যও মডেল হবে।
0 comments:
মন্তব্য করুন