বিদ্যুৎ ছাড়াই মাছ সংরক্ষণে মিনি হিমাগার

বিগত দশকে বাংলাদেশে মাছে বরফ দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। দেশের ভেতরে মাছ পরিবহনকালে দামি মাছসহ প্রায় সব মাছেই বরফ দেয়া হয়। জেলে বা মাছচাষিরা মাছ ধরার পর আড়তে নিয়ে আসা অবধি বরফ না দিলেও আড়তে বিক্রয়ের পর প্রায় সব পাইকার বা মাছ ব্যবসায়ীরা প্রজাতি নির্বিশেষে মাছে বরফ দিয়ে থাকেন। একটা সময় ছিল যখন মাছে বরফ দিলে ক্রেতারা ওই মাছকে নিম্নমানের বলে গণ্য করতেন, তাদের বিশ্বাস ছিল ‘পচা মাছেই বরফ দেয়া হয়’। 
মাছের গুণাগুণ সংরণ ও মাননিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে প্রায় সবাই সচেতন হয়েছেন। এতে মাছের আহরণোত্তর তি অনেক হ্রাস পেয়েছে। এফএও এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে পচনশীল খাদ্যসামগ্রী, বিশেষ করে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ দীর্ঘ সময় গুণগতমান বজায় রাখার জন্য একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণা পরিচালনা করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশ প্রসেসিং অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রো বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নওশাদ আলম। গবেষণায় তার কয়েকজন মাস্টার্সের শিার্থী সহযোগিতা করেন। 
গবেষণা সম্পর্কে ড. নওশাদ আলম বলেন, ২০০৩ সালে যেখানে দেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ২৮ ভাগ মাছ পচে নষ্ট হয়ে যেত, সেখানে ২০১২ সালে এই তি কমে এসে মোট উৎপাদনের শতকরা মাত্র ১২ ভাগে দাঁড়িয়েছে। এটা একটা বিরাট উন্নতি। বাংলাদেশের সব সেক্টরেই এই রকম ছোট ছোট উন্নতি চোখে পড়ার মতো। মাছে বরফ ব্যবহারের প্রশ্নে সব পর্যায়ের মাছ ব্যবসায়ীরা আগ্রহী হলেও এবং বরফের প্রচুর চাহিদা থাকলেও, বাজারে বরফের সরবরাহ নিতান্তই অপ্রতুল। গরম পড়ছে, তাই দিন দিন বরফের চাহিদাও বাড়ছে। বিদ্যুৎবিভ্রাট ও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বরফখণ্ড জমতে সময় লাগছে; কিন্তু বরফ মালিকেরা না-জমা খণ্ডতেই পুরো ফায়দা হাসিল করছেন। চাহিদা ও ব্যবহারের মাত্রা অনুসারে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন আকারের বরফখণ্ড তৈরি হয়। কক্সবাজার-চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ৭০-৮০ কেজি ওজনের, ৫ ঘন ফুট আকারের বরফখণ্ড ব্যবহৃত হয়। দেশের অভ্যন্তÍরে বিভিন্ন মৎস্য অবতরণকেন্দ্র ও বাজারে স্থাপিত ছোট ছোট বরফকলে সাধারণত ২০-২৫ কেজি ওজনের ২.৫ ঘন ফুট আকারের বরফখণ্ড তৈরি করা হয়।
ড. নওশাদ আলম জানান, সম্প্রতি দেশব্যাপী জরিপে দেখা গেছে শতকরা প্রায় ২৬ থেকে ৪৮ ভাগ বরফখণ্ডই শতকরা এক শ’ ভাগ জমানো হয় না। জেলাভিত্তিক হিসাবে শতকরা প্রায় ১৬ থেকে ৩২ ভাগ বরফখণ্ড কাদা-ময়লা ও আবর্জনায় সংক্রমিত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ বরফকলে বরফখণ্ড রাখার জন্য কোনো সংরণাগার নেই। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে বরফকল মালিকেরা বরফ তৈরি করে পলিথিন বস্তায় জড়িয়ে খোলা বারান্দায় স্তূপ করে রাখেন। পরের দিন ভোরে আট থেকে ১১টার মধ্যে এসব বরফখণ্ড বিক্রি হয়। প্রায় ৯ থেকে ২৪ ঘণ্টা খোলা আবহাওয়ায় পরে থাকায় শতকরা প্রায় ৩০- ৫০ ভাগ বরফ গলে যায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বরফকলে উৎপাদিত বরফখণ্ড অবশ্যই ঠাণ্ডা সংরণাগারে রাখা দরকার। 
নতুন হিমাগারের ডিজাইন : আকার ১০ ফুট দ্ধ ৬ ফুট দ্ধ ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি; মেঝে, দেয়াল, ছাদ ও দরজাÑ সব দিকেই তাপনিরোধী ব্যবস্থা; মাটি থেকে ১০ ইঞ্চি উঁচু কনক্রিট ফোর (প্লিন্থ) পলিস্টাইরিন সিট দিয়ে তাপনিরোধী করা; বাইরে ৫ ইঞ্চি ইটের দেয়াল ও ভেতরে ২ মিমি পুরো মেটাল সিটের মাঝখানে ২ ইঞ্চি পুরো পলিস্টাইরিন সিট দিয়ে তাপনিরোধী করা; ভেতরের দেয়াল স্টেনলেস-স্টিল বা অ্যালুমিনিয়াম সিট দিয়ে তৈরি হওয়ায় আঘাত বা ঘষা থেকে পলিস্টাইরিনকে রা করে; সামনের দিকে ৫ ইঞ্চি দ্ধ ৪ ইঞ্চি মোটা প্লাস্টিকের দরজা; ঢালু ছাদ (সামনের দিকে ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি, পেছনের দিক ৬ ফুট উচু) দুই স্তর জিআই সিট দিয়ে তৈরি যার মাঝে কর্কসিট বসানো; বরফ গলা পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য ফোরের নিচের ছিদ্র দিয়ে নির্গমণ পাইপ বসাতে হবে।
তিনি আরো জানান, মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকায় গ্রামেগঞ্জে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে এই রকম একটি হিমাগার নির্মাণ করে বরফখণ্ড ও বরফ দেয়া মাছকে কয়েক দিন সংরণ করা যাবে। আগ্রহী উদ্যোক্তা ও মাছ ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের কারিগরি সহায়তা নিয়ে এমন একটি হিমাগার তৈরি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন। -সূত্র: নয়াদিগন্ত।