পুকুরে গলদা চিংড়ির চাষে প্রচুর লাভ

আমিষভোজী মানুষের কাছে একটি পছন্দের খাদ্য হল মাছ। মাছ না হলেও চিংড়ি একই পদবাচ্য হিসাবে মাছের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়।বিভিন্ন ধরনের চিংড়ির মধ্যে গলদা চিংড়ির চাহিদা ও বাজারদর সব সময়ই বেশ ভালো। কখনো কখনো এর বাজারদর এত বেশি থাকে যে তা মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। একথা মাছ চাষিদের কাছে তা বেশ সুখবর। কারণ গলদা চিংড়ি চাষ করে তাঁরা বেশি লাভ করতে পারবেন। তাই মাছ চাষিরা নিশ্চিত লাভের লক্ষ্যে বেছে নিতে পারেন গলদা চাষ। মিষ্টি জলেও এর চাষ করা যায়। আর তাতে যে পোনামাছ চাষের পুকুর থেকে বেশি আয় আসবে, তা আর বলার অপেক্ষ রাখে না। তবে একক চাষ হোক বা মিশ্র চাষ, সঠিক প্রযুক্তি অবলম্বন করলেই পওিয়া যাবে কাঙ্খিত লাভ। স্বাদু জলের পুকুরে গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে কোন কোন  প্রযুক্তিগুলো মেনে চলা দরকার, এখানে তা উল্লেখ করা হল।

প্রথমে বলা যাক পুকুর নির্বাচনের কথা: দুই থেকে তিন বিঘা মাপের পাঁক বিহীন আয়তাকার পুকুর গলদা চিংড়ি চাষের উপোযোগী। এই পুকুরের তলদেশ সমতল হওয়া চাই এবং দেড় থেকে দুই মিটার জলের গভীরতা থাকা উচিত। যেসব পুকুরের জল শুকিয়ে যায়, সেই পুকুর প্রস্তুতির শুরুতে একর প্রতি ১০০-২০০ কেজি চুন ছড়িয়ে পুকুরের তলদেশে চাষ দিতে হবে। কয়েকদিন রোদ খাইয়ে এক ফুট গভীরতায় জল ঢোকাতে হবে। এর মধ্যে ৩০-৩৫কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ১৫ কেজি ইউরিয়া প্রতি একরে প্রয়োগ করে ১০-১৫ দিন পুকুরটিকে ফেলে রাখতে হবে। এর ফলে পর্যাপ্ত শ্যাওলা জন্মাবে। তারপর প্রয়োজনীয় উচ্চতা পর্যন্ত জল ভরতে হবে।


আর যদি পুকুরের জল শুকিয়ে না যায়, তাহলে একরপ্রতি প্রতি ফুট জলের গভীরতার জন্য ৩০০ কেজি মহুয়া খোল প্রয়োগ করতে হবে। এর ৫-৭ দিন পর একরপ্রতি ১০০-২০০ কেজি চুন দিতে হবে। মহুয়া খোল দেওয়ার ১০-১৫ দিন পরে ৩০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ১০ কেজি ইউরিয়া দিতে হবে। মহুয়া খোল দেওয়ার ২০-২২ দিন  পরে প্রয়োজনীয় উচ্চতায় জল ঢোকাতে হবে এবং মাছ মজুত করতে হবে। একক চাষে একরপ্রতি ১০-১২ হাজার পোস্ট লার্ভা ছাড়তে হবে, যেগুলি ১০-১৫ মিলিমিচার দৈর্ঘ্যরে। যদি বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র ব্যবহার করা যায়, তাহলে একর প্রতি ২০-২৫ হাজার পর্যন্ত গলদা চিংড়ির মীন ছাড়া যেতে পারে।মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে একরপ্রতি ৬০০০টি গলদা চিংড়ির চারা এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যওে ১৫০০টির থেকে ১৮০০ টি পোনা মাছ ছাড়তে হবে। এরিয়েটরের ব্যবস্থা থাকলে এই সংখ্যা দ্বিগুন করা যাবে। গলদার সঙ্গে পোনা মাছ হিসাবে রুই ,কাতলা ও গ্রাস কাপ ছাড়তে হবে। নিচের স্তরে বসবাসকারী মাছ ছাড়া যাবে না, কারণ গলদা চিংড়ি নিচের স্তরে বাস করে।

এবারে মাছ ছাড়ার পরবর্তী পরিচর্যার কথা বলা যাক: গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে কোন জৈব সার দেওয়া চলবে না। জৈবসার দিলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান কমে যাবে এবং চিংড়ির মড়ক হবে। প্রতি মাসে একবার  একরপ্রতি ২৫ কোজ চুন প্রয়োগ করতে হবে।এর এক সপ্তাহ পরে একরপ্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট জলে গুলে ছড়াতে হবে।প্রত্যেক দুই থেকে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে ১০-১৫ শতাংশ জল বের করে শুদ্ধ ঢোকাতে হবে। ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছ ও গলদা চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। প্রত্যেকদিন পরিপূরক খাদ্য দিতে হবে। গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রে পেলেট জাতীয় খাদ্য দেওয়াই ভাল। এই খাদ্য শতকরা ৩০ ভাগ প্রোটিন থাকা চাই। মজুত করা চিংড়ির ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য প্রথমদিকে প্রয়োগ করতে হবে। ক্রমশ পরে মান কমিয়ে এনে ৫ শতাংশ নিয়ে যেতে হবে। এই খাদ্য দুই ভাগে ভাগ করে দিতে হবে। সন্ধ্যেবেলা মোট খাদ্যের তিন চতুর্থাংশ, আর সকালবেলা  মোট খাদ্যের এক চতুর্থাংশ প্রয়োগ করতে হবে। আর পোনা মাছের ক্ষেত্রে মজুত করা মাছের মোট ওজনের ২ শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সম পরিমান চালের কুঁড়ো এবং সরষে বা বাদাম খোল মিশিয়ে খাদ্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই খাদ্য সকালের দিকে পুরোটাই দিতে হবে। মাঝরাতের পরে ও মেঘলা দিনে পুকুরের জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের অভাব হতে পারে। সেক্ষেত্রে এরিয়েটর চালাতে হবে।একক চাষে একরপ্রতি যদি ১২ হাজার গলদা মজুত করা হয়, তাহলে ছয় মাসে এগুলির এক একটির ওজন দাঁড়ায় ৪০-৬০ গ্রাম করে। শতকরা ৮০ ভাগ বাঁচার হার হলে একরপ্রতি ফলন হয় ৪৮০ কেজি।এরিয়েটর ব্যবস্থা যুক্ত অতি ঘন চাষে একরপ্রতি ২৪ হাজার চিংড়ি মজূত করলে ৯৬০ কেজি ফলন পাওয়া যাবে এবং আয় হবে ৬ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। মিশ্র চাষে ৬ হাজার গলদা চিংড়ি ও ১৮০০ পোনা মজুত করলে যথাক্রমে ৩৩৬ কেজি গলদা চিংড়ি ও ৭ কুইন্ট্যাল পোনা মাছ পাওয়া যাবে।এরিয়েটর ব্যবস্থা থাকলে অধিক ঘনত্বে পোনা মাছ ও গলদা চিংড়ি মিশ্র চাষ করে দ্বিগুন ফলন পাওয়া সম্ভব। এখানে বলা দরকার মোট আয়ের ৩৫-৪০ শতাংশ ব্যয় হবে এই চাষে। সেক্ষেত্রে ৬০-৬৫ শতাংশ হবে প্রকৃত লাভ। এই চাষ ছয় মাসের নিবিড় ব্যবস্থায় বছরে দুটি ফলনও নেওয়া যেতে পারে।