কচুরিপানার ধাপের ওপর সবজি চারার চাষ



প্রশ্ন: আমি একজন বিদেশ ফেরত বেকার যুবক। কৃষিতে আমার ব্যাপক আগ্রহ। আমি ৬৬শতাংশ জমিতে সমন্নিত মৎস এবং হাঁসের চাষ করতে আগ্রহি। কিন্তু তা আমি কিভাবে শুরু করব তা বুঝতে পারছি না।এবং কি কি লাগবে আমি সেটা বুঝতে পারছি না।আপনাদের সাহায্য আশা করছি। যেসব বিষয় জানতে চাই তা হলোঃ- 
; হাসের ঘর পুকুরের উপরে হলে কি সমস্যা হতে পারে?
;৬৬শতাংশ জমিতে পুকুর বানানোর পরে কত হাঁস পালন করা সম্ভব
;কত মাছ একপসাথে চাষ করা সম্ভব
;কোন জাতের হাস এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগি? ;ভালো জাতের হাসের বাচ্চা কোথায় পাওয়া যাবে? ধন্যবাদ প্রশ্নকারীর নাম ও ঠিকানা : সোহেল মাহমুদনোয়াখালি  সমাধান  (ক) হাঁসের ঘর পুকুরের উপর তো অবশ্যই রাখতে হবে বরং দুইটি ভাসমান ড্রমের উপর ঘরটি স্থাপন করলে আরও ভাল হবে। এতে হাঁসের মল দিন রাত পুকুরে পড়বে যা মাছের খাবার হবে। ঘরটি সারা পুকুরের যে কোন জায়গায় ভেসে থাকতে পারবে। পাড় থেকে বেঁধে রাখা দড়ি দিয়ে ঘরটি কাছে বা দূরে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি হাঁসের জন্য ঘরে ২ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে। ঘরের দরজা এত বড় হতে হবে যাতে হাঁস মাথা উঁচু রেখে ঘরে ঢুঁকতে পারে। ঘরের দেয়ালে বা ছাদে কোন ফাঁক থাকবে না যা দিয়ে আলো ঢুঁকতে পারে। নিচের মেঝে বাঁশের চটা পাশাপাশি আঁটকে তৈরি করতে হবে যাতে এর সামান্য ফাঁক দিয়ে তরল মল পানিতে পড়তে পারে। মেঝেতে ৬ ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে দিতে হবে যাতে হাঁস রাতে ডিম পাড়তে পারে। সন্ধ্যার পর ঘরের দরজা ভালভাবে আটঁকে ঘর পুকুরের মাঝে ঠেলে দিতে হবে যাতে শৃগাল বা অন্যান্য প্রাণী এসে হাঁস ধরে না খেতে পারে। (খ) ৬৬ শতক আয়তনের পুকুরে ৬৬ টি হাঁস পালন করা যাবে যার মধ্যে ৭ টি পুরুষ হাঁস থাকবে। ৩-৪ মাস বয়সের হাঁস দিয়ে হাঁস পালন শুরু করতে হবে। হাঁস সংগ্রহের পর পশুসম্পদ অফিস থেকে ভ্যাক্সিন দিয়ে নিতে হবে। ১৭-১৮ সপ্তাহ বয়সে হাঁস ডিম দেয়া শুরু করে। প্রতিটি মাদী হাঁস বছরে ১৮০-৩০০ টি ডিম দেয়। ১ বছরে প্রতিটি হাঁসের ওজন হবে ২ কেজি। (গ) ৬৬ শতক আয়তনের পুকুরে প্রতিটি ১০০ গ্রাম ওজনের ৫২৮ টি কাতলা, ৫২৮ টি রুই, ২৬৪ টি মৃগেল ও ২৬৪ টি কমন কার্প অর্থাৎ সর্বমোট ১৫৮৪ টি মাছের পোনা ছাড়তে হবে। প্রতিটি ১ কেজি সাইজ হলে অথবা ১ বছর পর মাছ ধরতে হবে। ১ বছর পর ধরলে আপনি ১০৫০ কেজি মাছ পেতে পারেন। মাছের খাবারের ৬০% আসবে হাঁসের মল থেকে। বাকীটা সম্পুরক খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে দিতে হবে। (ঘ) খাঁকী ক্যাম্পবেল হাঁস পালন সবচেয়ে লাভজনক। তবে ইন্ডিয়ান রানার জাতের হাঁস মাছের সাথে চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্রতিটি হাঁসকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ১০০ গ্রাম করে চাউলের কুঁড়া ও পোল্ট্রিফিড অর্ধাঅর্ধি হারে মিশিয়ে হাঁসের ঘরের সামনের বারান্দায় একটি পাত্রে সরবরাহ করে খাওয়াতে হবে। (ঙ) পশুসম্পদ বিভাগের ৩ টি আঞ্চলিক হাঁস খামার আছে। যেমন খুলনা ও কিশোরগঞ্জ। প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারী পোল্ট্রি ফার্ম আছে। প্রশিকা ও ব্রাকের সাথেও যোগাযোগ করা যেতে পারে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানের বড় বড় পোল্ট্রি হ্যাচারী সমূহে হাঁসের বাচ্চা খোজ করতে পারেন। ধন্যবাদ।
দেশের পশ্চাৎপদ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশের বসবাস বরিশালের হিন্দু অধুষ্যিত আগৈলঝাড়া উপজেলায়। এ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের জন্য উপজেলার একটি বড় অংশ জুড়ে নিম্ন জলাভূমি বা বিলের ভৌগলিক অবস্থানকে দায়ি করা হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় এখানকার প্রায় সকল জমি জলমগ্ন থাকে। তাই এ অঞ্চলের বাসিন্দারা নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল আবাদের জন্য ভূমির বিকল্প হিসেবে ভাসমান কচুরিপানার ধাপ ব্যবহার করে আসছে।   ধাপগুলোতে প্রধানত লালশাক, পুঁইশাক, ডাটা, মরিচ, করলা, ঢেঁড়শ, হলুদ, শশা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে থাকেন। প্রায় বারমাসই বিলাঞ্চলে এ ধরণের সবজি চাষ হয়ে থাকে। এ ছাড়াও করলা, বটবটি, সিম, পেঁপেঁ, লাউ, কুমড়া, মরিচ, বেগুনসহ নানা জাতের সবজির চারা করে তা বিক্রি করে এ উপজেলার তিনটি গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক পরিবার আজ নিজেদের ভাগ্য বদলিয়েছেন।  আগৈলঝাড়া উপজেলার গোয়াইল গ্রামের মিরাজ বিশ্বাস দীর্ঘ ১৫ বছর, মোকসেদ বিশ্বাস ২৫, সিরাজ ২০, বেল্লাল হোসেন ১৫, তোফাজ্জেল হোসেন ২০ বছর, বাশাইল গ্রামের খালেক সরদার ২৬, ছোট বাশাইল গ্রামের সামচু সরদার ২৫ বছর ধরে ধাপের ওপর বিভিন্ন জাতের সবজির চারা করে তা বিক্রি করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন।   চাষী মিরাজ বিশ্বাস (৩৫) জানান, তার বাবাও সবজির চারা করে তা বিক্রি করেছেন। এখন তিনি (মিরাজ) এ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পরেছেন। জৈষ্ঠ মাসের শেষেরদিকে বিভিন্ন জাতের সবজির চারা চাষের কার্যক্রম শুরু করা হয়। চাষীরা এ সময় বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কচুরিপানার বড় বড় দলকে সন্নিবিশিত করে রেখে দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই তাতে পঁচন ধরে। পঁচন ধরা কচুরিপানাই হয়ে যায় ধাপ। প্রতিটি ধাপেই পর্যাপ্ত জৈবসারের কারনে সবজির চারাগুলো অত্যন্ত উর্বর হয়।  চাষী মোকসেদ বিশ্বাস (৫০) জানান, স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ ক্রয় করে বাড়িতে মাঁচা বেঁধে সবজির বীজ দিয়ে চারা গজিয়ে তা ভাসমান ধাপের ওপর রাখা হয়। প্রত্যেকটি ভাসমান ধাপে চারবার চারা করা হয়। প্রথমবার একমাস পরিচর্যার পর চারাগুলো বিক্রি করে দেয়া হলেও পরবর্তীতে ১৫-২০ দিনের মধ্যেই চারা বিক্রি করা যায়। এভাবেই প্রতিটি ধাপে চারবার চারা করে তা বিক্রি করা হয়। সবজির চারাগুলো এখান থেকে ফরিদপুর, চাঁদপুর, মাগুরা, ফেনিসহ স্থানীয় হাটবাজারের পাইকাররা এসে ক্রয় করে নিয়ে যায়। চাষী তোফাজ্জেল হোসেন (৬৫) জানান, তাদের উৎপাদিত চারা শহিসেবে বিক্রি করা হয়। পরিচর্যাসহ তাদের একশ চারা বিক্রির উপযোগী করতে খরচ হয় দেড়শ টাকা। আর তা বিক্রি করা হয় তিন থেকে সাড়ে তিনশ টাকায়। তিনি আরো জানান, তাদের এ চারার ব্যবসায় বাড়ির গৃহিনীদের ভূমিকা অপরিসীম।  স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বাশাইল, গোয়াইল ও ছোট বাশাইল গ্রামে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর আগ থেকেই ধাপের ওপর সবজির চারা করে তা বিক্রি করা হয়। ধাপের ওপর স্বল্পসময়ের মধ্যে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে চাষীরা অধিক মুনাফা অর্জন করায় ওই তিন গ্রামের দেখা দেখি বর্তমানে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর উন্মুক্ত জলাশয়ে একই পদ্ধতিতে সবজি চাষসহ সবজির চারা করে তা বিক্রির ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তুলনামূলক ভাবে অনেকাংশে চাষাবাদ কম হচ্ছে।   আগৈলঝাড়া উপজেলায় ধাপের ওপর স্বল্পব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জনের এ পদ্ধতি দেখে পার্শ্ববর্তী উজিরপুরের সাতলা, বাগধা, জল্লা, কোটালীপাড়ার বিশারকান্দি, ধারাবাশাইল, মাচারতাঁরা, তালপুকুরিয়া, ডুমুরিয়া, তারাকান্দর, ছত্রকান্দা, পিঞ্জুরী. রামশীল, কলাবাড়ী, শুয়াগ্রাম, সাতুরিয়া, আলামদি, নারায়নখানা, সাদুল্লাপুর গ্রামের শতকরা ৮০ ভাগ লোক বর্তমানে ধাপের ওপর সবজি ও চারা চাষের ব্যবসাকে বেঁছে নিয়েছেন। এ চাষে খরচ কম কিন্তু আয় বেশী হওয়ায় গরীব কৃষকদের মাঝে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রান্তীক চাষীদের ভাষ্যমতে, স্থানীয় কৃষি অফিস চাষীদের উদ্বুদ্ধসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা করলে ধাপের ওপর সবজি চাষের ব্যাপকতা যেমন বাড়বে তেমনি চাষীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে সবজির চাহিদাও পূরন করা সম্ভব হবে।