কালোজিরা চাষে ৭ গুণ লাভ

মসলাজাতীয় ফসলের মধ্যে কালোজিরা চাষ এখনো আমাদের দেশে পুরোদমে শুরু হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে দেশের কিছু এলাকায় কালোজিরা চাষ হচ্ছে। অপ্রচলিত ফসল কালোজিরার ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। এ দেশের মাটি এবং আবহাওয়াও কালোজিরা চাষের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপযোগী। অথচ এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা তেমনভাবে এগিয়ে আসছেন না। এ ব্যাপারে সরকার এগিয়ে এলে বাংলাদেশ কালোজিরা উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে পারে। তাতে করে বিদেশ থেকে আর তা আমদানি করতে হবে না, দেশের টাকা দেশেই থাকবে। অন্যদিকে কৃষকও লাভবান হবে। কারণ কালোজিরা চাষ করে তিন মাসের মধ্যে একজন কৃষক সাতগুণ লাভবান হতে পারেন।


আজকাল বিভিন্ন ভেষজ ওষুধের দোকানে কালোজিরার তেল বিক্রি হয়। প্রতিকেজির দাম ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এর ক্যাপসুলও পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। দাম অনেক বেশি। কালোজিরা ফুলের মধুও শরীরের জন্য বিশেষ উপযোগী। কালোজিরা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কালোজিরা বেটে এর ভর্তা খাওয়া যায়। বেকারি, হোটেল ইত্যাদির খাবারেও কালোজিরা মেশানো হয়। এর আরো অনেক বাণিজ্যিক দিক আছে। অর্থাৎ এর বাণিজ্যিক দিক ক্রমেই বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভমিকা পালন করতে পারে কালোজিরা। এক হিসেবে দেখা গেছে ১০ শতাংশ জমিতে কালোজিরার চাষ করতে সাড়ে চার থেকে পাঁচশ টাকা খরচ হয়। আর এই খরচে ৩৫ কেজির মতো কালোজিরা পাওয়া যায়। যার পাইকারি বাজারমূল্য কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ একজন কৃষক ৫০০ টাকা খরচ করে তিন মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় করতে পারেন।

কালোজিরা একটি মাঝারি জাতীয় নরম মৌসুমি গাছ। একবার ফুল ও ফল হয়ে মরে যায়। ২০-৩০ ফুট উচ্চতার এ গাছের পাতা সরু ও চিকন। জোড়া ধরে সোজা হয়ে জন্মানো সবুজ পাতার মধ্যে অনেকটা ছাই ছাই রং মেশানো মনে হয়। কালোজিরার বীজ কালো এবং ত্রিকোনাকৃতির হয়। বীজ কোষ খাজ আকারে ফলের সাথে লম্বালম্বিভাবে থাকে। প্রতিটি ফলে ২০-২৫টি বীজ থাকতে পারে। শুকনো বীজ এবং বীজ থেকে পাওয়া যায় তেল। অন্যান্য রবি ফসলের চেয়ে এর আবাদি খরচ কম, অথচ লাভ অনেক বেশি। তাই কালোজিরা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। বাজারজাতকরণের সুবিধা বাড়ানো গেলে কালোজিরা আবাদের মাধ্যমেই ঘুরে যেতে পারে এখানকার কৃষকদের ভাগ্যের চাকা। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের কিছু কিছু স্থানে কৃষকরা নিজ উদ্যোগে কালোজিরা চাষ করছেন। অনেকেই এর চাষ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেছেন। কারণ, তারা দেখছেন এর উৎপাদন খরচ যেমন কম, তেমনি লাভও বেশি। যশোর নড়াইলের চরাঞ্চলে কালোজিরার আবাদ করে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় মধুমতি নদী চরাঞ্চলের ৭টি গ্রামে বিগত তিন বছর ধরে কালোজিরার চাষাবাদ চলছে।

এক একর জমিতে কালোজিরা চাষে খরচ পড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। অন্য ফসলের মতো এখানে বারবার সেচ না দিয়ে মাত্র একবার দিলেই চলে। প্রয়োজন হয় সার ও কীটনাশক ব্যবহারও। এসবের ফলে কম পড়ে উৎপাদন ব্যয়।
প্রচুর রোদ লাগে এমন যেকোনো সমতল জমিতে কালোজিরা চাষ করা যায়। তবে বেলে দো-আঁশ মাটিতে কালোজিরার চাষ ভালো হয়। বাংলাদেশে বেলে দো-আঁশ মাটির জমির অভাব নেই। কালোজিরা চাষের জন্য ভালো করে কুপিয়ে বা লাঙল দিয়ে মাটি মিহি করতে হবে। বীজ বপনের পর নিড়ানি দিয়ে ঘাস ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

অগ্রহায়ণের শেষে থেকে কালোজিরার বীজ বপন করতে হয়। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে পৌষের প্রথমে লাগানো ভালো। ১০ শতাংশ জমিতে ৩৫০/৪০০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। ১০ শতাংশ বা তার কম জমিতে চাষ করলে ৫ সেমি/২ ইঞ্চি উঁচু বেড তৈরি করা ভালো। ১০ শতাংশ জমিতে ১০ কেজি পচা গোবর ও ২ কেজি পচা খৈল অথবা ১০ কেজি পরিমাণ যেকোনো কম্পোস্ট মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে বেড তৈরি করা যেতে পারে। মিহি মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু বেড তৈরি করলে বেশি সার লাগবে না। খেয়াল রাখতে হবে যাতে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি (১৫ সেমি) মাটি আলগা থাকে। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে মাটিতে ‘জো’ এলে জমি তৈরি করা আরম্ভ করা যেতে পারে। সার মেশানোর এক সপ্তাহ পরে প্রয়োজন হলে একবার নিড়ানি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। আলাদা করে বীজ শোধনের প্রয়োজন নেই। তবে বোনার আগে ভালো করে ধুয়ে ধুলাবালি ও চিটা বীজ সরিয়ে নেয়া ভালো। ভেজা বীজ বপন করা উচিত।

১ ফুট বা ৩০ সেমি, দূরে দূরে ১-৪ ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে ২/৩টি করে বীজ পুঁততে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ বেশি গভীরে যেন না যায়। বীজ লাগানোর পরই হালকা করে মাটি দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে। পাখিতে বীজ খেতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।


কালোজিরার জমিতে সেচের প্রয়োজন নেই। তবে নতুন চারা লাগানোর পর রোদ বেশি হলে ছিটিয়ে পানি দেয়া যেতে পারে। সন্ধ্যায় পানি ছিটিয়ে দেয়া ভালো। জমি তৈরির সময় ছাড়া পরে আর সার দেয়ার প্রয়োজন নেই। কালোজিরা সহজে পোকামাকড়ে আক্রান্ত করে না। বরং এর স্বাভাবিক পোকামাকড় ধ্বংসের ক্ষমকতা আছে। সে রকম রোগবালাই হয় না।

বীজ বপনের ১২ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে কালোজিরার চারা গজাবে। আর ৩৫ থেকে ৪২ দিনের মধ্যে ফুল আসবে। কালোজিরার স্ত্রী-পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়। নীলচে সাদা রংয়ের ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে। গোলাকার ফলের কিনারায় আকর্শির মত বাড়তি অংশ থাকে। ৬০-৮৫ দিনের মধ্যে কালোজিরার ফল পাকবে। সর্বমোট ১২ সপ্তাহের মধ্যে ফসল পাকবে। অর্থাৎ পৌষ মাসের প্রথমে চাষ করলে ফাল্গুন চৈত্রে ফসল তোলা যাবে। ১০ শতাংশ জমিতে উপরোক্ত নিয়ম অনুসারে চাষ করলে গড়ে ৩০-৩৫ কেজি কালোজিরা পাওয়া যাবে। ফাল্গুন চৈত্রে গাছ মরে গেলে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে হাতে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করা যায়। গাছে সামান্য রস থাকতেই ফল সংগ্রহ করা উচিত। নয়তো বীজ জমিতে ঝরে যেতে পারে। চটের বস্তায় বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে। অন্তত, এক বছর পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়। শুকনো, অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।

গাইবান্দা সদরের জামালপুরের বর্গাচাষি তুহিন থেকে জানা যায়, ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কালোজিরার আবাদ করেছেন। বিঘাপ্রতি বর্গার জন্য ৬৫০০ হাজার টাকা এবং উৎপাদনে করচ ৫৫০০ হাজার টাকা। মোট বিঘাপ্রতি ১২ হাজার টাকা করচে তার জিরা বিক্রি করে আয় হয় ২৫ তেকে ৩০ হাজার টাকা্ এতে তিনি অনেক খুশি। কেননা কালোজিরা আবাদে পানি, সার বা নিরানিতে খরচ নেই বললেই চলে।
হবুবা আকতার, এআইসিও, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা

2 comments:

Kamol said... Udyokta

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কালজিরার চাষ পদ্দতির একটাই সাইট পেলাম। যা আমার অনেক উপকারে আসলো। আমি চাষ করব, ৫ শতাংশে প্রথমে ট্রাই করব। আশা করি তথ্য দিয়ে আরও সাহায্য করবেন ।

Badal said... Udyokta

ধন্যবাদ আপনাকেও।