ছায়াযুক্ত পুকুরে মাছ ও সবজির সমন্বিত ইফকাস প্রযুক্তি

টাটকা শাকসবজি অথবা পুকুরের সদ্য তোলা মাছের স্বাদের কথা ভাবতেই ভালো লাগে। আর তা যদি হয় একেবারেই কীটনাশকমুক্ত তাহলে তো কথাই নেই। কেননা বাজারের মাছ ও সবজিতে প্রচুর ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের প্রমাণ মিলছে। ফলে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রভাবে দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে অল্প জায়গায় বেশি খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন এখন সময়ের দাবি।

আমাদের দেশে গ্রামীণ বরিশাল অঞ্চলে মানুষের মাছের চাহিদা পূরণের জন্য পরিবারভিত্তিক পুকুর খনন করা হয়। প্রথাগতভাবে এসব পুকুরকে ছোট মাছের ফাঁদ-পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা হয় যেখানে সামান্য কার্পজাতীয় মাছের পোনা মজুদ করে শুধু পারিবারিক চাহিদা মেটানোর জন্য মাছ চাষ করা হয়। 
ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকোয়াকালচারের ওপর ভিত্তি করে পরিবারের পুষ্টি নিরাপত্তার লক্ষ্যে ইন্টিগ্রেটেড ফোটিং কেজ অ্যাকোয়াজিওপনিক্স সিস্টেম (ইফকাস) প্রযুক্তিতে ছায়াযুক্ত পুকুরে একত্রে মাছ ও শাকসবজির সমন্বিত চাষ করে সম্প্রতি সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় আন্তর্জাতিক এনজিও, ওয়ার্ল্ডফিশের অর্থায়নে কৃষি পুষ্টি এক্সটেনশন প্রকল্প (এএনএপি) বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে গ্রামীণ কৃষকদের সাথে ছায়াযুক্ত পুকুরে ইফকাস কাজ করে ওই সফলতা পেয়েছেন প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মাহফুজুল হক।

ডনজের উদ্ভাবিত ইফকাস প্রযুক্তি সম্পর্কে ড. হক বলেন, বরিশাল অঞ্চলের পুকুরপাড়ে প্রচুর গাছপালা থাকে যেগুলো সাধারণত রান্নার জ্বালানি, ফল এবং কাঠ উৎপাদন ও বিক্রয়ের জন্য রোপণ করা হয়। পুকুরের পাড়ে এসব গাছ পুকুরের পানিতে ছায়া তৈরি করে সূর্যালোক অনুপ্রবেশে বাধা প্রদান করে। এতে করে পুকুরের পানিতে মাছের উৎপাদন ও পাড়ে সবজি উৎপাদন নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়। তবে পুকুরের পানিতে যেখানে সূর্যালোক পড়ে সে অঞ্চলে সবজি উৎপাদনের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। পুকুরের পাড়ে ছায়াময় প্রকৃতি এবং পানিতে সূর্যালোক এক্সপোজার এলাকা বিবেচনা করে একটি নতুন বিশেষ পানিভিত্তিক অ্যাকোয়াকালচার সিস্টেম, ইফকাসের ওপর একটি অ্যাকশন গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে খাঁচায় ও পানিতে মাছের জন্য যে খাদ্য দেয়া হয় তাতে নাইট্রোজেনাস ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয়, যা মাছের বৃদ্ধির জন্য তিকারক। কিন্তু উদ্ভিদের জন্য চমৎকার সার। ইফকাসের কাঠামোয় সবজির মাদায় ব্যবহৃত পুকুরের কাদায় যে জৈব সার থাকে যেটি উদ্ভিদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট সার।

ইফকাস তৈরির পদ্ধতি
একটি ৯ বর্গমিটার আয়তনের লোহার বার দিয়ে তৈরি ফ্রেমকে ভাসিয়ে রাখার জন্য কাঠামোটির চার কোণে ফোট বসানোর জন্য চারটি খাঁজ রাখা হয়। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত প্লাস্টিকের কনটেইনার দিয়ে তৈরি ফোট ইফকাসকে ভাসিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। লোহার ফ্রেমের অনুপ্রস্থ বরাবর দুটি ফোটের মাঝে সবজি রোপণের জন্য একটি করে মাদা তৈরি করা হয় যেখানে পুকুরের শুকনো কাদা, গোবর ও অন্যান্য জৈবসার মিশিয়ে দেয়া হয়। মাদার নিম্নাংশে পুকুরের পানিতে লেগে থাকার কারণে পানি থেকে উদ্ভিদ সারবস্তু সহজে গ্রহণ করতে পারে, এতে করে উদ্ভিদের জন্য কোনো সেচের প্রয়োজন হয় না। কাঠামোর উপরিতলের গঠন বরাবর সবজিগাছ বেয়ে চলার জন্য বাঁশের ফালি দিয়ে একটি মাচা তৈরি করা হয়।
চাষিদের পছন্দ অনুযায়ী লতানো সবজি এবং পুকুরের পানি থেকে পুষ্টি শোষণ করতে পারবে এ রকম জাতের সবজি মাদায় রোপণ করা যায়। জালের খাঁচার ভেতর মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা ১০০ ঘনমিটার হারে মজুদ করে ভাসমান খাদ্য প্রয়োগ করে ইফকাসের বাইরে, পুকুরের অবশিষ্ট এলাকা সাধারণ কার্প চাষ কৌশল অনুযায়ী রুই-কাতলা চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়।
গবেষণার প্রথম চক্রের (জুলাই-অক্টোবর, ২০১৩) শুরুতে নয়টি পরিবারের সাথে গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক ছিল। চাষিরা সব ইফকাস পুকুরের সূর্যালোক এক্সপোজার এলাকায় স্থাপন করেন।

ড. মাহফুজ আরো বলেন, চাষিরা তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী সবজি যেমনÑ শসা, চিচিঙ্গা, পুঁইশাক, করলা ও শিম ইত্যাদি লতানো সবজি হিসেবে রোপণ করতে পারবেন।

আধা ছায়াময় ও গভীর-ছায়াময় পুকুরের ইফকাসে তেলাপিয়ার উৎপাদন যথাক্রমে ৩১ ও ৫২ কেজি/৯ বর্গমিটার গভীর ছায়াময় পুকুরের ইফকাসে তেলাপিয়ার উৎপাদন কম হওয়ার সম্ভাব্য কারণ পুকুরের পানিতে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের উপস্থিতি, যা পুকুরে গাছের পাতা ও অন্যান্য জৈব অংশ পচে তৈরি হয়। গবেষণা থেকে দরিদ্র কৃষকদের জন্য ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকোয়াকালচার-অ্যাগ্রিকালচার সম্পর্কিত নতুন প্রযুক্তিটি ইতোমধ্যে কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সম্প্রসারণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, উদ্ভাবিত প্রযুক্তি এখন নেপালের দুটি জেলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু ছায়াময় পুকুরের জন্যই নয় বরং বহুমালিকানা পুকুর, বিল, খাল, নদী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধ এলাকা ইত্যাদিতে ব্যবহার করলে কৃষকেরা পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ ও সবজি বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন। ।
আরিফুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা, ময়মনসিংহ

(সৌজন্যে নয়াদিগন্ত)