পাঙ্গাস মাছের পরিচিতি ও একক (নিবিড়) চাষ পদ্ধতি
আবহমানকাল থেকে পাঙ্গাস মাছ এদেশের মানুষের জন্য রসনার উৎস হিসেবে পরিচিত। এই মাছটি প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে—বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে—পাওয়া যায়। এক সময়ে পাঙ্গাস মাছ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে উচ্চবিত্তের মাছ হিসেবে বিবেচিত ছিল। বর্তমানে পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সাথে সাথে এর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদনও ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তবে পুকুরে পাঙ্গাস চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকায় আশির দশক থেকেই এর ওপর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
পাঙ্গাস মাছের বিভিন্ন জাত
পাঙ্গাস মাছের জাতগুলোর মধ্যে দেশী পাঙ্গাস ও থাই পাঙ্গাস সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নিচে তাদের পরিচিতি—
১) দেশী পাঙ্গাস
দেশী পাঙ্গাসের রূপালী রঙের পিঠের দিকে কালচে এবং পার্শ্ব রেখার ওপরে সামান্য ধূসর। এ মাছের দেহে কোনো আঁশ নেই। এখনও আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাঙ্গাস সুস্বাদু এবং বেশি মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে এ মাছটি বেশি পাওয়া যায়। এরা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীসহ প্রধান নদীগুলোতে এর পোনা পাওয়া যায়।
২) থাই পাঙ্গাস
এদের আদি বাসস্থান থাইল্যান্ডে; এছাড়াও কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলের দেশে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে বিদেশী এ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন করানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাস একটি জনপ্রিয় নাম। দেশী পাঙ্গাসের চেয়ে এ জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ মাছটি সর্বোচ্চ ১০–১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
পাঙ্গাস মাছের চাষ পদ্ধতি (একক/নিবিড় চাষ)
মাছ চাষের পদ্ধতিটি নির্ভর করে পুকুর বা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিবেশগত অবস্থা, পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, পুঁজি, মানসম্মত পোনা প্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় চাষ পদ্ধতি কেমন হবে। এখানে আমরা জানব পাঙ্গাস মাছের একক চাষ বা নিবিড় চাষ সম্পর্কে।
একক বা নিবিড় চাষ বলতে কী বোঝায়?
এ পদ্ধতিতে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এক্ষেত্রে আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে বেশি মুনাফা করা যায়। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১৫–২০ টন পাঙ্গাস উৎপাদন করা সম্ভব। একক চাষে প্রতি হেক্টরে ৮–১০ সেমি আকারের ২০,০০০–২৫,০০০টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিগত বছরের পোনা মজুদ করে অধিক উৎপাদন ও বেশি মুনাফা বাড়ানো সম্ভব।
পাঙ্গাস চাষের পুকুর নির্বাচন
পাঙ্গাস চাষের পুকুর আয়তাকার হলে ভালো হয়। পুকুরের তলা ভালোভাবে সমতল করতে হবে। পানির গভীরতা ১.৫–২.০ মিটার রাখা দরকার।
পাঙ্গাস চাষের জন্য দোআঁশ মাটির পুকুর সবচেয়ে ভালো। জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত পানি দেওয়ার জন্য পুকুরের কাছে গভীর বা অগভীর নলকূপ থাকা দরকার।
বর্ষায় বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে পুকুর ভেঙে না যায়—এ জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় মেরামত সেরে ফেলতে হবে।
সর্বোপরি এমন জায়গায় পুকুর নির্বাচন করতে হবে যেখানে যোগাযোগ সুবিধা ভালো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে।
পুকুর প্রস্তুতি
পুকুর নির্বাচন করার পরের কাজ হলো পুকুরকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে নেওয়া।
১) জলজ আগাছা পরিষ্কার
পুকুরে নানা প্রকৃতির জলজ আগাছা থাকলে প্রথমেই সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
২) অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছ অপসারণ
পাঙ্গাস চাষের আগে শোল, বোয়াল, গজার, টাকি, বাইম, মলা, ঢেলা ইত্যাদি মাছ অপসারণ করতে হবে। উপায়—
ঘন ফাঁসের জাল বারবার টেনে সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে।
পুকুরের পানি পরিষ্কার করে এবং সম্ভব হলে তলার মাটি লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে দিতে হবে।
অনেক সময় সব পদ্ধতিতেও সম্পূর্ণ ধ্বংস করা যায় না—তখন স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করে দমন করা যেতে পারে।
৩) চুন প্রয়োগ
পুকুরকে মাছ চাষের উপযুক্ত ও টেকসই করতে চুন প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে সব পুকুরের পানিতে অম্লত্বের সমস্যা নেই, সেখানে প্রতি হেক্টরে ২৫০–৩০০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। চুন গুঁড়ো করে মিহি করে নিলে কার্যকারিতা অনেক বেড়ে যায়।
৪) সার প্রয়োগ (জৈব + রাসায়নিক)
প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত চুন প্রয়োগের ৪–৫ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হয়।
নতুন পুকুর ও বেলে মাটির পুকুরে জৈব সার বেশি দিতে হয়।
পুরাতন কাদাযুক্ত পুকুরে রাসায়নিক সারের হার বেশি হবে।
পুকুর প্রস্তুতকালীন সারের মাত্রা (শতক প্রতি):
গোবর ৮–১০ কেজি অথবা মুরগির বিষ্ঠা ৪–৫ কেজি
টিএসপি ১০০ গ্রাম (জৈব সারের সাথে ৮–১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে)
ইউরিয়া ১০০ গ্রাম (ব্যবহারের আগে মিশিয়ে)
এরপর মিশ্রণটি সমগ্র পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৪–৫ দিন পর পানির রং সবুজ বা বাদামী হলে সাধারণত পোনা মজুদের উপযোগী হয়।
পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন
পুকুর প্রস্তুতি শেষ হলে উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন পাঙ্গাসের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে পোনা নেওয়া উত্তম। পরিবহনের সময় সতর্কতা জরুরি—
পরিবহনের আগে চৌবাচ্চায় ৪–৫ ঘণ্টা পোনাকে উপোস রেখে টেকসই করতে হবে।
পরিবহনের সময় পোনাকে বেশি উত্তেজিত করা উচিত নয়।
খাদ্য প্রয়োগ
পাঙ্গাস চাষে পুকুরে তৈরি প্রাকৃতিক খাবার আশানুরূপ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই সুষম খাদ্য প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। চাষ পর্যায়ে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য না দিলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে।
খাদ্যের পরিমাণ মাছের বয়স ও দেহের ওজনের উপর নির্ভর করে।
১৫ দিন পরপর কয়েকটি মাছের ওজন পরীক্ষা করে বৃদ্ধি ঠিক আছে কিনা দেখুন।
খাদ্য পুকুরের আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত ৬–৮টি স্থানে দেওয়া ভালো।
দানাদার খাবার ছিটিয়ে এবং সম্পূরক খাবার বল আকারে নির্দিষ্ট স্থানে দিতে হয়।
খাবার একবারে না দিয়ে ২–৩ বারে ভাগ করে দিলে কার্যকারিতা বাড়ে।
প্রয়োজনমতো চুন ও সার প্রয়োগ করাও জরুরি।
মাছ সংগ্রহ (আংশিক আহরণ)
বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মাছ মজুদের ৫–৬ মাস পর যখন গড় ওজন ৫০০–৬০০ গ্রাম হয়, তখন মজুদকৃত মাছের ৫০% বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে অবশিষ্ট মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
শেষ কথা
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে মাছ চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সারা দেশের প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর পুকুর-দীঘি এবং প্রায় ৬–৭ লক্ষ হেক্টর জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাস চাষ করলে দেশের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বিপুল সংখ্যক বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের। প্রায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের ঐতিহ্য “মাছে ভাতে বাঙালি”—কে পুনরুদ্ধারে তাই পাঙ্গাস মাছের চাষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।










0 comments:
মন্তব্য করুন