বারিকম্পোস্ট সেপারেটর

মাটির ভাল স্বাস্থ্য ও টেকসই উর্বরা ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে মাটিতে বেশি পরিমাণ জৈব পদার্থ ব্যবহার করা ও কম পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের উপর। ক্রমবর্ধমান মাটির উর্বরা ঘাটতি বর্তমানে একটি কঠিন সমস্যা। ৬০ ভাগেরও বেশি আবাদি জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১.৭ ভাগেরও নিচে নেমে গেছে। তাই বেশি পরিমাণ জৈব সারের ব্যবহারের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ হ্রাস করতে হবে। ভার্মিকম্পোস্ট এমন এক ধরনের সার যা ব্যবহারে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ৫০ ভাগ পর্যন্ত সাশ্রয় করা সম্ভব। কিছু নির্বাচিত প্রজাতির কেঁচো রয়েছে যা গোবর, বায়োস্লারি, খড়, পচনশীল আবর্জনা, লতাপাতা ইত্যাদি খেয়ে মলত্যাগ করে ও তার দেহ হতে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হবে। এগুলো জৈব পদার্থের সাথে মিশে পুষ্টিমান বাড়িয়ে দেবে। বর্জ্য পদার্থ যখন চায়ের গুঁড়ার মত ঝুরঝুরে হয় তখন বুঝতে হবে সার তৈরি হয়ে গেছে। কেঁচো সার তৈরি হতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগে। প্রকৃতপক্ষে কেঁচোর মলই হল এ সার। এ অবস্থায় চালুনি দিয়ে চেলে কোকুন (কেঁচোর ডিম) এবং ঝরঝরা অংশ আলাদা করতে হবে। ভার্মিকম্পোস্ট বা কেঁচো সার তৈরিতে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য কাজ হল কম্পোস্ট থেকে কেঁচো আলাদা করা ও ছেঁকে নির্দিষ্ট সাইজের গুঁড়া প্যাকেটজাত করার জন্য আলাদা করা। চালনির মাধ্যমে হাতে চেলে কাংখিত আকারের সার পাওয়ার জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। হাতে চেলে কেঁচো আলাদা করা যেমন কষ্টের তেমনি কেঁচোর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তাছাড়া এভাবে সার কমপক্ষে দু’বার হাতে চালতে হয়। ভার্মিকম্পোস্ট তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক হলেও চালার কাজটির বেশ কঠিন। এসব সমস্যা মাথায় রেখেই বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিজ্ঞানীরা একটি চালুনি যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যা দিয়ে একই সাথে কেঁচো আলাদা করে আশানুরূপ সার পাওয়া সম্ভব।
যন্ত্রটির প্রধান বৈশিষ্ট্য:১. সাধারণ লোহা দিয়ে তৈরি করা যায়;
২. মাত্র ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর দিয়ে চালানো যায়;
৩. সার থেকে কেঁচোকে সফলভাবে পুরোপুরি আলাদা করা যায়;
৪. কম সময় ও খরচে বাণিজ্যিকভিত্তিতে কেঁচো সার তৈরির কাজ করা যায়;
৫. মহিলা/পুরুষ এটা সহজেই চালাতে পারে;
৬. যন্ত্রটি চালাতে ৩ জন লোকের প্রয়োজন হয়;
৭. যন্ত্রটি দিয়ে ৫ মি.মি. এর চেয়ে কম ব্যসার্ধের চা পাতার মত সার সহজেই পাওয়া যায়;
৮. ঘণ্টায় ১৫০০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট চালা যায় যেখানে হাতে চাললে ৩ জন লোকে ঘণ্টায় ২৪০ কেজি ভার্মিকম্পোস্ট চালতে পারে।
যন্ত্রটির বিবরণ:১. এম এস এঙ্গেলবার দিয়ে তৈরি করা ফ্রেমে ছাকনি সিলিন্ডার বসানো থাকে;
২. এস এস নেট (৫ মেশ) দিয়ে আবৃত সিলিন্ডারাকৃতির ছাঁকনিটি একটি শ্যাফটের সাহায্যে দু’টি বিয়ারিং এর উপর স্থাপিত থাকে;
৩. ০.৫ অশ্বশক্তির বৈদ্যুতিক মোটর থেকে মেইন শ্যাফটে শক্তি দেয়া হয়;
৪. সিলিন্ডার শ্যাফেটর ঘূর্ণন গতি মিনিটে ভার্মিকম্পোস্টের জন্য ১০ বার এবং ট্রাইকোকম্পোস্টের জন্য ১৫ বার;
৫. সিলিন্ডারটি ইনপুট থেকে আউটপুটের দিকে ১০০ কোণে আনত থাকে;
৬. মাপ: দৈর্ঘ্য ৪ ফুট (প্রস্থ ৩ ফুট) উচ্চতা ৫ ফুট;
৭. ওজন: ৯৫ কেজি।
কার্যপ্রণালী:যন্ত্রটি একটা ছায়াযুক্ত সমতল ও খোলা জায়গায় বসিয়ে বৈদ্যুতিক লাইনে মটরকে সংযোগ দিন। সুইচ অন করলে মটর চালু হবে এবং সিলিন্ডারাকৃতির চালনি ঘুরতে থাকবে। প্রবেশ হপারে পিট/চাঁড়ি থেকে সংগ্রহকৃত কম্পোস্ট ঢালুন। হালকা আর্দ্রতাসম্পন্ন কম্পোস্ট সমানভাবে চালনিতে প্রবেশ করান। মুহূর্তের মধ্যে কাংখিত চা পাতার মতন সার চালনির নিচে সংগ্রহ ট্রেতে জমা হবে এবং কেঁচো ও বড় আকৃতির বর্জ্য নির্গমন পথ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। উল্লেখ্য যে, কেঁচোগুলো একদিকে জমা হবে এবং বর্জ্য দূরে জমা হবে। কেঁচোগুলোকে সামান্য বর্জ্যসহ আলাদা করে নতুন পিটে/চাঁড়িতে দেয়া যাবে। বড় আকৃতির বর্জ্য কম্পোস্ট তৈরির জন্য পুনরায় পিটে/চাঁড়িতে দেয়া যাবে।সতর্কতা:যন্ত্রটি চালানোর সময় ঢিলাঢালা পোশাক না পরাই ভাল। বৈদ্যুতিক লাইন যাতে শর্টসার্কিট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।পরীক্ষার ফলাফল:কার্যক্ষমতা: ১,৫০০ কেজি/ঘণ্টা (ভার্মিকম্পোস্টে যখন ১৬-১৮% আর্দ্রতা থাকে)
চালুনি খরচ: ০.০৭ টাকা/কেজি (ভার্মিকম্পোস্ট সেপারেটর) ও ০.৪০ টাকা/কেজি (হাতে)। মূল্য:২০,০০০ টাকা।
বিশেষ পরামর্শ:কেঁচো সার তৈরির চাঁড়ি/রিঙগুলো থেকে সার সংগ্রহের আগে যদি স্তরে স্তরে সার হাত দিয়ে আলগা করে এক থেকে দু’ঘণ্টা রাখার পর সার সংগ্রহ করা হয় তবে কেঁচো নিচের দিকে চলে যায় ফলে সংগ্রহকৃত সারে কেঁচো কম থাকে। এভাবে কয়েক স্তরে সারকে আলগা করে রেখে ঘণ্টা খানেক পরে সার সংগ্রহ করলে কেঁচো কম পৃথক করতে হয়, অনেক কেঁচোকে একসাথে সংগ্রহ করা যায় ও কেঁচো আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া থেকে রেহাই পায়।
লেখক: মোহাম্মদ এরশাদুল হক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
ফার্ম মেশিনারি এন্ড পোস্টহারভেস্ট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর