‘ফিস হসপিটাল’ নির্মাণ নিয়ে কাজ করছেন
তিনি। ইতোমধ্যে
তিনি চিংড়ি ও মৎস্য
চাষ উন্নয়ন এবং চাষী দক্ষতা
ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে
৮ রকমের সহায়ক যন্ত্রপাতি
উদ্ভাবন করেছেন। যা
মৎস্যচাষীদের ব্যাপক কাজে আসছে। তার
উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতি তিনি বাজারজাত করতে
চান, কিন্তু অর্থের অভাবে
তা পারছেন না।
আর যিনি এত পরিশ্রম
এবং নিজের চিন্তা দিয়ে
এত কিছু উদ্ভাবন করেছেন,
তিনি হলেন যশোর শহরের
চাঁচড়া এলাকার শেখ আশরাফ
হোসেন হান্টু।
পরনে লুঙ্গি, গায়ে পুরনো শার্ট,
পায়ে চটি, হাতে থলে। দেখলে
পাগল বলেই মনে হবে। অথচ
এই পাগলের মাথায় রয়েছে
মাছ চাষের উন্নতি ও
বিকাশের নানা পরিকল্পনা।
দামি দামি বিদেশি যন্ত্রের
দেশীয় রূপ দিয়ে তিনি
রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তৈরি
করেছেন অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্র (অ্যারেটন),
অক্সিজেন পরিমাপক মিটার, পানির জৈব-ঘনত্ব নির্ণায়ক যন্ত্র
ও কয়েক প্রকার ওষুধ। পকেটে
টাকা নেই কিন্তু মাথায়
আছে চিন্তা। বেশভুষা
দেখে তাচ্ছিল্য করে তাকে অবহেলা
করলেও তিনি পিছু হটেন
না। শুধু
জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবেই তিনি
একের পর এক নতুন
নতুন যন্ত্রের দেশীয় রূপ দিচ্ছেন। যশোরের
চাঁচড়ার মৎস্যভাণ্ডারে জন্মগ্রহণকারী হান্টুর ছোটবেলা থেকেই ভাবনা ছিল
মাছ চাষ। পিতা
মারা যাওয়ার পর ৯ ভাইয়ের
পরিবার সামাল দিতে গিয়ে
তার লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র
৮ম শ্রেণীতে যেয়ে থেমে যায়। দারিদ্র্য
মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজে
মাছ চাষে যুক্ত হতে
না পারলেও মাছ চাষের
উন্নয়নে তার চিন্তা ও
আবিষ্কার থেমে থাকেনি।
চাষের উন্নতির জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ
করতে তিনি ছুটে গেছেন
ভারতে। সেখান
থেকে ফিরে তিনি শুরু
করেন আধুনিক যন্ত্রপাতির দেশীয়
রূপ দানের কাজ।
রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানের
নানা বিষয় ৭ম শ্রেণী
পাস মানুষটার মাথায় শুধু গিজগিজ
করে। তিনি
অনর্গল বলে যান বিজ্ঞানের
নানা সূত্র। এসব
ধরেই এগিয়ে যায় তার
আবিষ্কার।
অক্সিজেন সরবরাহ
যন্ত্র
মাছের
রেণু পোনা উৎপাদন এবং
পরিবহনে অক্সিজেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আশরাফ
হোসেন হান্টুর আবিষ্কৃত অক্সিজেন সরবরাহ যন্ত্রটি প্রতি
ঘণ্টায় এক হাজার টন
বায়ু পানিতে মেশাতে পারে। যা
থেকে মাছের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন
স্বল্পতম সময়েই জোগান দেয়া
সম্ভব। হান্টু
মাছ চাষের প্রচলিত পদ্ধতি
দেখে মনে করেন মাছের
খাদ্য খাবারের চেয়ে বেশি যে
জিনিসটির প্রয়োজন হয় তা হচ্ছে
অক্সিজেন। রাতের
শেষ দিকে মাছের অক্সিজেন
ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ
করে। সকালে
মাছগুলো পানির উপরে এসে
খাবি খেতে থাকে।
তখন পুকুরে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন
দেয়া না গেলে মাছের
মৃত্যু ঘটে। মাছ
চাষীরা অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে তাদের
পুকুরে স্যালো পাম্প ব্যবহার
করেন। এ
পাম্প দিয়ে পুকুরের পানি
পুকুরেই ফেলে পানিতে ঢেউ
খেলানো হয়। এ
পদ্ধতিতে ৫ বিঘা পরিমাণ
জলাশয়ে মাছের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের
জোগান দিতে ৪/৫টি
স্যালো পাম্প বিরামহীনভাবে ৬/৭ ঘণ্টা চালাতে
হয়। হান্টুর
এ অবিষ্কার সময় ও জ্বালানির
সাশ্রয় করছে। ৫
বিঘা জলাশয়ে তার যন্ত্র এক
ঘণ্টা চালালেই মাছ প্রয়োজনীয় অক্সিজেন
পেয়ে যায়। আর
এ যন্ত্রটি তৈরি করতে খরচ
মাত্র ৫ হাজার টাকা। হান্টুর
যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা স্যালো
পাম্পের মতোই। মূলত
পাম্পের সঙ্গে আলাদা একটি
বায়ু সঞ্চালন চেম্বার যুক্ত করেই তৈরি
হয়েছে যন্ত্রটি।
ডিজিটাল অক্সিজেন
মিটার
পানিতে
অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ না
করতে পারলে মাছ চাষ
যথাযথ হয় না।
অক্সিজেন সংকট বা আধিক্যের
কারণে মাছ মারা যায়। বিশেষ
করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি
চাষ শুধু অক্সিজেন ব্যবস্থাপনার
অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নানা
রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মাছ।
এ জন্য মাছচাষীদের পানির
অক্সিজেন পরিমাপ জরুরি।
বিদেশে তৈরি এ যন্ত্রটির
মূল্য ৫৫ থেকে ৬০
হাজার টাকা। হান্টু
সরল কন্ডাক্টিভিটি ও একটি ইলেকট্রোড
ব্যবহার করে তৈরি করেছেন
অক্সিজেন মিটার। যার
মূল্য মাত্র ৫ থেকে
৬ হাজার টাকা।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে দেশীয়ভাবে
তৈরি এ মিটারটি পরীক্ষা
করে দেখা গেছে বিদেশি
মিটারের সমান ফলাফল দিচ্ছে। হান্টু
মনে করে সস্তা এবং
সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এ মিটারটি মৎস্যচাষীরা
ব্যবহার করতে পারবে।
হান্টু জানিয়েছে, অক্সিজেন দুই পরমাণু বিশিষ্ট
একটি অণু পানিতে অল্প
পরিমাণে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এই
অক্সিজেনের সাহায্যে মাছ শ্বাসকার্য চালায়। অক্সিজেন
ঋণাত্মকধর্মী মৌল হওয়ায় জলাশয়ের
ক্ষতিকারক গ্যাসের সঙ্গে সহজেই বিক্রিয়া
করে। এতে
অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। পুকুরের
প্রতি লিটার পানিতে ৭
মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকার দরকার।
এর পরিমাণ ১ মিলিগ্রামে
নামলে মাছ মরে যায়। ৭
মিলিগ্রামের কম থাকলে মাছের
বৃদ্ধি কমে যায়।
হান্টুর যন্ত্রটি অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় করে
চাষীদের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা
নিতে সহায়তা করবে।
জৈব খাদ্য পরিমাণ
যন্ত্র
পানিতে
জৈব খাদ্যের পরিমাণ দেখেই খাদ্য
সরবরাহ করার নিয়ম।
সাধারণত মাছচাষীরা হাতের কনুই পর্যন্ত
পানিতে ডুবিয়ে খাদ্যের পরিমাণ জানার চেষ্টা
করেন। কিন্তু
সবার হাত এক রকম
না হওয়ায় পরীক্ষাটি সঠিক হয় না। বর্তমানে
মৎস্য গবেষকরা যে যন্ত্র দিয়ে
পানিতে খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করেন
তার মূল্য ১০ থেকে
১২ হাজার টাকা।
হান্টুর যন্ত্রটি তৈরি করেছেন মাত্র
দুটি উপকরণ দিয়ে।
একটি মিটার স্কেলের প্রান্তে
চাকতি লাগিয়ে তৈরি হয়েছে যন্ত্রটি। স্কেলের
গায়ে ৪ রঙের ৪টি
সিগন্যাল রয়েছে। লাল,
হলুদ, সবুজ ও কালো। স্কেলটি
জলাশয়ে লাল সিগন্যাল পর্যন্ত
ডুবালে চাকতি অদৃশ্য হলে
বুঝা যাবে জলাশয়ের অবস্থা
ভালো না, খাদ্য ও
সার প্রয়োগ বন্ধ করে জলীয়
পরিবেশ উন্নতকরণের চেষ্টা করতে হবে। হলুদ
সিগন্যাল পর্যন্ত ডুবালে চাকতি অদৃশ্য
হলে বুঝতে হবে জলাশয়ে
প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ বেশি।
সবুজ সিগনাল পর্যন্ত ডুবালে
চাকতি অদৃশ্য হলে বুঝতে
হবে জলাশয়ের অবস্থা ভালো, নিয়মিত
খাদ্য দিলেই চলবে এবং
কালো সিগন্যাল পর্যন্ত চাকতি অদৃশ্য হলে
বোঝা যাবে জলাশয়ে কোনো
প্রকৃতিক খাদ্য নেই।
খাদ্য প্রদানের এই সহজ পদ্ধতি
নির্ণয়ের যন্ত্রটির মূল্য মাত্র ১০০
টাকা।
মাছ পরিবহন যন্ত্র
আমাদের
দেশে সাধারণত মাছ পরিবহনের জন্য
বড় বড় হাঁড়ি অথবা
ব্যারেল ব্যবহার করা হয়।
যাত্রাপথে মাছের অক্সিজেন নিশ্চিত
করার জন্য হাত দিয়ে
চাপড়ানো হয়। হান্টুর
আবিষ্কৃত যন্ত্র ব্যবহার করলে
মাছের অক্সিজেন নিশ্চিত হবে। হাত
দিয়ে চাপড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।
ট্রাকের
এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত
পর্যন্ত একটি পাইপলাইন থাকে,
এই লাইন থেকে ঠিক
নরম পাইপ দিয়ে মাছের
প্রতিটি পাত্রে অক্সিজেন সরবরাহ
করা হয়। সে
জন্য মাছের পাত্রে হাত
দিয়ে চাপড়ানোর প্রয়োজন হয় না।
যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত
১টি ট্রাকে ৪০টি ব্যারেলে
মৎস্য পরিবহন করতে সাধারণ
পদ্ধতিতে ৪০ জন শ্রমিকের
প্রয়োজন হয়। প্রতি
শ্রমিককে দিতে হয় ৫শ’
টাকা করে। এতে
খরচ হয় ২০ হাজার
টাকা। হান্টুর
যন্ত্রটি চালাতে খরচ হয়
প্রতি ঘণ্টায় হাফ লিটার ডিজেল। যশোর
থেকে ঢাকা যেতে সময়
লাগে ৬ ঘণ্টা।
অর্থাৎ খরচ হয় দেড়শ’
টাকা।
শুধু খরচ কম নয়,
প্রচলিত পদ্ধতিতে প্লাস্টিক ব্যারেলে ও অ্যালুমিনিয়াম পাতিলে
হাত দিয়ে চাপড়ানোর পানিতে
অক্সিজেন তৈরি করা হয়। এতে
মাছের গায়ে অনেক সময়
ক্ষত সৃষ্টি হয়।
মাছের গায়ে লালা থাকে
না। ও
খসখসে হয়ে যায়।
ফলে মাছ দুর্বল হয়ে
পড়ে। মাছ
অনেক সময় মারা যায়। হান্টুর
আবিষ্কৃত দুইটি পদ্ধতিতে মাছ
পরিবহন করা যায়।
একটি হলো বায়ু সঞ্চালন
করে। অপরটি
সিলিন্ডারে অক্সিজেন গ্যাস দিয়ে।
বায়ু সঞ্চালন করে প্রতি ব্যারেলে
২০ কেজি মাছ পরিবহন
করা যায়। সিলিন্ডার
দিয়ে একটি প্লাস্টিক পাইপলাইন
বের করে সেখান থেকে
সরু পাইপের মাধ্যমে মাছ
পরিবহন পাত্রে অক্সিজেন সরবরাহ
করা হয়। এতে
সাধারণ পদ্ধতির চেয়ে আড়াইগুণ ঘনত্বে
মাছ পরিবহন সম্ভব।
কয়েক প্রকার ওষুধ
হান্টুর
উদ্ভাবনের তালিকায় কয়েক প্রকার ওষুধ
রয়েছে। এসব
ওষুধ জলাশয়ে সময়মতো প্রয়োগ করা গেলে মাছের
রোগ দমন সম্ভব।
হান্টু চিংড়ির ভাইরাস দমনে কার্যকর
ভূমিকা রাখতে পারবে বলে
জানিয়েছেন। দরিদ্রতা
তাকে আটকে ধরার চেষ্টা
করলেও বসে নেই হান্টু। মাছের
উন্নতিই তার জীবনের উন্নতি
ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। তার
মতে, নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে
প্রতিনিয়ত কৃষি জমির ওপর
চাপ বাড়ছে। দক্ষিণাঞ্চলে
কৃষি জমি কমে যাওয়ার
প্রধান কারণ নতুন নতুন
ঘের কেটে মাছ চাষ। তিনি
এ ঘের কাটার প্রবণতা
বন্ধ করে পুরনো ঘেরে
আধুনিক প্রযুক্তির প্রচলন করতে চাচ্ছেন। এ
জন্য অনেক এলাকা ঘুরে
ঘুরে আধুনিক চাষের কথা
বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি বুঝিয়েছেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে মৎস্যচাষীরা অনুমানের ভিত্তিতে মাছের খাবার ও
অক্সিজেন দিয়ে থাকেন।
যার কারণে সঠিক সময়ে
মাছ সঠিক খাবার পায়
না। এতে
মাছের বৃদ্ধি কাক্সিক্ষত মনে
হয় না। কিন্তু
তার বেশভুষা দেখে তাকে বেশিরভাগ
লোকই মেনে নেয়নি।
বিশেষ করে স্কুলের গণ্ডি
পার না হওয়া এক
ব্যক্তির কাছ থেকে কেউ
জ্ঞান নিতে চায়নি।
তবুও আশাবাদী হান্টু। তার
আশা মাছ চাষে একদিন
আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ হবেই। একই
সঙ্গে তার আশঙ্কা কোনো
কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি তার এই বিদেশি
যন্ত্রের দেশীয় রূপ দানের
পদ্ধতি চুরি করে নিজের
বলে চালিয়ে দিতে পারেন।
তবে তিনি জানিয়েছেন, অর্থ
কষ্টের কারণে তিনি কাক্সিক্ষত
কাজ করতে পারছেন না। কেউ
যদি অর্থ বিনিয়োগ করেন,
তবে তিনি তাঁর জ্ঞানকে
কাজে লাগিয়ে আরও অনেক যন্ত্রপাতি
আবিষ্কার করতে পারবেন।
কেউ কি এগিয়ে আসবেন
হান্টুর আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি বাজারজাত করার জন্য?
0 comments:
মন্তব্য করুন