পুকুরেই হবে মলা মাছের চাষ। আগে আমরা দেখতাম খালে-বিলে দল বেঁধে মলা মাছ চলাফেরা
করতো। আর এরা ধরাও পরতো ঝাঁকে ঝাঁকে। ছোটবেলায় আমরা খুব মজা করে মলা মাছ মারতাম- বিশেষ
করে ছিপজাল দিয়ে। কোন এক স্রোতের মুখে এই জাল ফেলে বসে থাকতাম। পানি একটু স্বচ্ছ হলে
পরিস্কার দেখা যেত দল বেঁধে মলা মাছ আসছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারলে পুরো মলা মাছের
দলটিকে উঠিয়ে ফেলা যেত।
স্থানীয় নাম: মলা, ময়া, মোয়া, মকা, মৈাকা, মুদে, মোলঙ্গী, মৌরালা,মলেন্দা ও মৌচি ।
ডিম দেয়ার ক্ষমতা : ১,০০০-৮,০০০ টি।
প্রজনন: প্রথম বছরেই প্রজননক্ষম হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এরা প্রজনন করে থাকে। বছরে কমপক্ষে ২-৩ বার ডিম দেয়।
পুষ্টিমান: মলাতে প্রচুর
ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম,
ফসফরাস ও আয়রণ থাকে।
পুরো দল মানে অনেক মাছ। এই মাছটি বর্তমানে বিপন্নের পথে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই
এই মাছটিকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মলা মাছের পুষ্টিগুণ ও ওষুধিগুণের কথা সবারই কম
বেশি জানা আছে। মলা মাছ পুকুরেই ডিম দিয়ে থাকে। দরকার শুধু উদ্যোগের। একবার শুধু কিছু
মলা মাছকে পুকুরে ছেড়ে দিলেই হল। মাস দুয়েক পর থেকেই মলা মাছ পুকুরে ডিম দিতে শুরু
করে। একক চাষেও মলা মাছের সম্ভাবনা আছে। একক চাষের জন্য প্রথমে পুকুরে রটেনন দিয়ে
অবঞ্চিত মাছ মেরে ফেলতে হবে। তারপর চুন দিয়ে পরিস্কার পানিতে পুকুর পূর্ণ করতে হবে।
পানি ৩ ফুট রাখা বাঞ্চনীয়। এরপর আশপাশের যেকোন উৎস হতে কিছু মলা মাছের পোনা বা বড়
মলা মাছ পুকুরে ছাড়তে হবে। জীবিত মলা মাছ পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।
তাই আশেপাশের যে কোন উৎস হতে খুব সর্তকতার সাথে মলা মাছ বহন করতে হবে। একবার মাছ
স্টক হলেই হল। প্রজননের জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। মাসখানেক পর থেকেই মলা মাছ ডিম
দিতে শুরু করবে। প্রথম দুইমাস কোন মাছ ধরা যাবে না। শুধু বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে
হবে। দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর মাছ আহরণ করা যাবে। মাছ আহরণের সময়
এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে শুধু বড় মলা মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো
জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যাবে। মলা মাছের
প্রচুর পরিমাণে প্রজননের জন্য অমাবস্যায় বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে শ্যলো দিয়ে পানি
দেয়ার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাচ্চা পাওয়া যাবে। খাবার হিসেবে শুধুমাত্র
অটোকুঁড়া ব্যবহার করা উচিত। খাবার পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে। অন্য খাবার ব্যবহার করলে
পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। পানি বেশি সবুজ হলে মলা মাছের ডিমপাড়া বন্ধ
হয়ে যেতে পারে বা বাচ্চা দেয়ার হার কমে যেতে পারে। কারণ, মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বাস করতে ও প্রজনন করতে
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ জন্য খাবার হিসেবে অটোকুঁড়া দিলে ভাল। অটোকুঁড়া পানিতে ভেসে
থাকে বিধায় সমস্তô খাবার মাছে খেয়ে ফেলতে
পারে। তাই পানিও পরিস্কার থাকে।
মলা মাছের বাজারজাতঃ মলা মাছ একটি নরম প্রকৃতির মাছ। পুকুর থেকে মাছ আহরণের পর মলা
মাছকে বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায় না। ২ থেকে ৩ ঘন্টা পর থেকেই মলা মাছ
পচে যাওয়া শুরু করে। তাই মলা মাছকে পুকুর থেকে ধরেই বরফ দিতে হবে। এভাবে মাছ সংরক্ষণ
করলে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত টাটকা অবস্থায় রাখা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের যে
কোন প্রান্তে বাজারজাত করা সম্ভব।
মলা মাছের উপযোগিতাঃ মলা মাছ চাষের খাদ্য খরচ কম। পোনা কিনতে টাকার দরকার হয় না
এবং বাজারমূল্য উচ্চ হওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।
বগুড়ায় শুরু হয়েছে বানিজ্যিকভাবে চাষ: রীক্ষামূলক চাষে সফলতা পাওয়ার
পর বগুড়ার তিনটি উপজেলার পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে মাছটির। এতে মলা মাছের জোগান
যেমন বাড়ছে, তেমনি লাভবান হচ্ছেন চাষীরাও।
বগুড়ায় পুকুরে মলা মাছের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এজন্য
বেছে নেয়া হয় বগুড়া সদর, নন্দীগ্রাম ও শাজাহানপুরের
নয়টি পুকুর। জেলা মত্স্য অফিসের তত্ত্বাবধানে পুকুরগুলোয় মলা মাছের রেণু ছাড়া হয়। এতে
সফলতাও আসে। আর এখন জেলার ২০-২২টি পুকুরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশী এ মাছের চাষ হচ্ছে।
উপজেলা মত্স্য অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মলা মাছের চাষ করছেন শাজাহানপুর উপজেলার
চোপীনগর গ্রামের মহিবুর রহমান মজনু। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মত্স্য বিভাগের
সহযোগিতায় মলা মাছের তিন কেজি রেণু সংগ্রহ করি। পরে তা পুকুরে ছেড়ে দিই। গত তিন মাসে
শতাধিক কেজি মলা মাছ বিক্রি করেছি। প্রতিবেশী আরো চার-পাঁচজন এখন মলা মাছের চাষ শুরু
করেছেন।’
বগুড়া জেলা মত্স্য অফিস সূত্রে জানা যায়,
চাষ শুরুর
আগে তিনটি উপজেলার মাছচাষীদের বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর তাদের রেণু সরবরাহ
করা হয়।
মত্স্য অফিসের সহায়তায় পুকুরে মলা মাছ চাষ করছেন বগুড়া সদর উপজেলার মত্স্যচাষী
শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রথমে পুকুরে তিন
কেজি রেণু ছাড়েন। এ পর্যন্ত তিনি ৪০ কেজি মাছ বিক্রি করেছেন। এ থেকে আয় হয়েছে ১৩ হাজার
টাকা। এর বিপরীতে তার খরচ হয়েছে ৪ হাজার টাকা।
মত্স্য কর্মকর্তারা জানান, পুকুরে রেণু ছাড়ার
৮০-৯০ দিনের মধ্যেই মলা মাছ বিক্রি করা সম্ভব। যেকোনো পরিবেশেই মাছটি খাপ খাওয়াতে পারে।
এ কারণে বাড়তেও খুব বেশি সময় নেয় না। পুকুরে মলা চাষে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বগুড়া জেলা মত্স্য কর্মকর্তা খিরোদ কুমার পাল জানান, পরীক্ষামূলক চাষ সফল হওয়ায় চাষীরা এখন নিজ উদ্যোগেই
পুকুরে মলা মাছ চাষ করছেন। তবে এখন পর্যন্ত ঠিক কী পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয়েছে, তা নিরূপণ করা যায়নি। গত সাত-আট মাসের চাষে ভালো
উৎপাদন পাওয়া গেছে।
এদিকে পুকুরে চাষ শুরু হওয়ার পর স্থানীয় বাজারগুলোয় মলা মাছের সরবরাহ বেড়েছে। এতে
দামও কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। মাছ ব্যবসায়ীরা জনান, দক্ষিণাঞ্চল ও নাটোর থেকে আসা মলা মাছ আগে ৫০০-৬০০
টাকায় বিক্রি হতো। পুকুরে উৎপাদিত মাছ বাজারে আসায় এখন তা ৪০০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উৎপাদন বাড়লে দাম আরো কমে আসবে।
0 comments:
মন্তব্য করুন