টি-শার্টে সৃজনশীল উদ্যোগ।

তরুণদের পছন্দের টি-শার্ট তৈরি করেই শুরু হতে পারে চমৎকার ব্যবসায় উদ্যোগ
তরুণ প্রজন্মের পছন্দের পোশাকের মধ্যে এগিয়ে আছে টি-শার্ট। পরতে আরাম, সব ধরনের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। ফ্যাশনের ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করার ফলে টি-শার্ট হয়ে উঠেছে সময়ের সবচেয়ে আলোচিত পোশাক। পোশাকে সৃজনশীলতা ও দেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণের এই পোশাক দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নতুন নতুন ডিজাইনের এসব টি-শার্ট তরুণদের পোশাকে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে এই টি-শার্ট শিল্প বিকশিত হতে থাকে। প্রথমে একটি, তারপর আরও দুটিএভাবে আজ প্রায় শতাধিক টি-শার্টের দোকান হয়েছে একটি মার্কেটেই। বিভিন্ন বড় শপিং মলসহ সারা দেশে তৈরি হচ্ছে টি-শার্টের দোকান। গত কয়েক বছরে এ পোশাকের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনই টি-শার্টের দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেকেই তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করেছেন টি-শার্টের ব্যবসা। টি-শার্ট বিক্রির ব্যবসা যেমন করা যায়, তেমনই টি-শার্ট তৈরি করে তা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহও করা যায়। সৃজনশীল আর উদ্যমী তরুণেরা ফ্যাশনের এ শাখাকে বেছে নিতে পারেন পেশা হিসেবে। 
সবার আগে লক্ষ্য স্থির 
টি-শার্টের ব্যবসা শুরু করা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এটি শুরুর আগে ভাবতে হবে, আপনি নিজে কতটা এ কাজের সঙ্গে মানানসই ও উপযোগী। বাংলাদেশের ফ্যাশনে দেশীয় আঙ্গিকে টি-শার্ট জনপ্রিয় করার জন্য অনেক কাজ করেছেন ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান। তিনি বলেন, হুট করে এ পেশায় আসা যাবে না। সবার আগে ভালোমতো লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে। আপনি এ কাজটি ঠিকমতো করতে পারবেন কি না, ঠিক করে নিন আগে। এ কাজের জন্য অবশ্যই সৃজনশীল হতে হবে। এরই মধ্যে অনেকে টি-শার্টের ব্যবসা শুরু করেছেন। তাই মাথায় রাখতে হবে, আপনার কাজ যেন অন্যদের থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রম হয়। আর এই টি-শার্ট আপনি কাদের জন্য তৈরি করবেন, সেটিও ঠিক করে রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেটি শুরুতেই ভেবে নিতে হবে। নিজের সামর্থ্য কতটুকু আছে, তা ঠিক রেখে এই কাজ শুরু করা উচিত। লক্ষ্য স্থির করে আস্তে আস্তে এ পেশা সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যাঁরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের সঙ্গে থেকে কাজ শিখতে পারেন বলেমনে করেন বাহার রহমান। 
জানতে হবে টি-শার্ট সম্পর্কে
সবকিছু ঠিক করে আপনি যখন টি-শার্ট তৈরির কথা ভাবছেন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখা। ফ্যাশন হাউস তারা মার্কার স্বত্বাধিকারী অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, টি-শার্ট ব্যবসা শুরুর আগে এ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি। এ-সংক্রান্ত জ্ঞান থাকলে কাজ করা ও কাজ বোঝা অনেক সহজ হয় বলে মনে করেন অভিজিৎ চৌধুরী। বাজারে সেলাইয়ের নিয়মকানুন, কাটিং, ডাইং-সংক্রান্ত অনেক ধরনের বই পাওয়া যায়। এসব পড়লে টি-শার্ট বানানোর নিয়মকানুন সম্পর্কে অনেক পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি ইন্টারনেটেও এ বিষয়ে অনেক তথ্য রয়েছে। 
টি-শার্ট তৈরির আগে ও পরে
টি-শার্ট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেওয়ার পর আপনি শুরু করতে পারেন কাজ। প্রথমে আপনাকে রং বাছাই করতে হবে। আপনি কোন রঙের টি-শার্ট তৈরি করবেন, তা ঠিক করুন। ফ্যাশন হাউস পঙিক্তর স্বত্বাধিকারী আবদুল্লাহ আল আমিন জানান, টি-শার্ট তৈরির জন্য সাধারণত গার্মেন্টস সিঙ্গেল জার্সি, রিপ ও ফাইন কাপড় ব্যবহার করা হয়। এই টি-শার্টের কাপড়গুলোর পুরুত্ব শুরু হয় ১৪০ থেকে ২২০ জিএসএম। এগুলো হতে হবে সিলিকন ওয়াশ বা এনজাইম ওয়াশ করা কাপড়। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে এসব কাপড় কিনতে পাওয়া যায়। তবে এখন বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে এসব কাপড় অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায় বলে জানালেন অভিজিৎ চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে কাপড়ের দামটা একটু বেশি পড়বে, গুণগত মান অনেক উন্নত হবে। কাপড় তৈরির পর মাপ অনুসারে টি-শার্ট তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঁচ ধরনের সাইজের টি-শার্টের মাপ তৈরি করতে হবে। এসব হচ্ছে ছোট, মাঝারি, বড়, এক্সএল ও ট্রিপল এক্সএল। অনেক পোশাক কারখানা এসব টি-শার্ট বানানোর অর্ডার নিয়ে থাকে। খোঁজ করে তাদের কাছেই বিভিন্ন ধরনের টি-শার্ট তৈরি করে নিতে পারেন। টি-শার্টের গলায় যে কাপড় থাকে, তাকে রিপ বলে। এটিও আলাদাভাবে তৈরি করতে হয়। বিভিন্ন গার্মেন্টস এসব তৈরি করে থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে এটি তৈরি করে নেওয়া যায়। 
ডিজাইন হলো মূল বিষয়
টি-শার্ট তৈরির পর মূল কাজটি হলো ডিজাইন করা। কেননা বাজারে অনেক ধরনের টি-শার্ট পাওয়া যায়, কাপড়ও প্রায় একই ধরনের, কিন্তু চাহিদার পার্থক্য হয় ডিজাইনের ভিন্নতার কারণে। অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, টি-শার্টের ডিজাইন করার আগে ডিজাইন সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। বিশিষ্ট কোনো চিত্রশিল্পীকে দিয়ে টি-শার্টের ডিজাইন করছেন অনেকে। আবার এ-সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক তরুণও টি-শার্টের ডিজাইন করতে পারেন। টি-শার্টের ডিজাইন সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটি হচ্ছে, টি-শার্টের ওপরে কাপড় দিয়েই ডিজাইন করা, অন্যটি হলো চিত্রকর্ম দিয়ে টি-শার্ট তৈরি। কোন রঙের টি-শার্টের সঙ্গে কোন রঙের ডিজাইন খাপ খায় তা সঠিকভাবে নির্বাচন করতে হবে। অভিজিৎ চৌধুরীর মতে, টি-শার্ট একটি দৈনিক পত্রিকার মতো। প্রতিদিন এর নতুন নতুন ডিজাইন হয়। তাই ডিজাইনে নতুনত্ব থাকতে হবে। সাম্প্রতিক আলোচিত বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য উঠে আসতে পারে টি-শার্টের জমিনে। আবার কারণ ছাড়াই কোনো বিষয় নিয়ে টি-শার্ট করলে মানুষের আগ্রহ পাওয়া যাবে না। এটা মূলত একটা বার্তা বহন করে। এই বার্তা যেন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রেখে টি-শার্টের ডিজাইন করতে হবে। ডিজাইনে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, সুলতান, জয়নুল, হাসন রাজার মুখাবয়ব, ময়মনসিংহ গীতিকাসহ লোকজ মোটিফ এসেছে। কবিতার চরণ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই’, ‘নদী ও সবুজ বাঁচানপ্রভৃতি স্লোগানে তৈরি হয়েছে অনেক ধরনের টি-শার্ট। আবার মজার বিষয় নিয়ে তৈরি বিভিন্ন টি-শার্টও এখন বেশ জনপ্রিয়। তাই টি-শার্ট ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
জানতে হবে কারিগরি নানা দিক 
একটি টি-শার্টের ডিজাইন তৈরির পর তা কীভাবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়, তা জানতে হবে। ডিজাইনটি ঠিকমতো ফুটে ওঠা একটি টি-শার্ট তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য ভালো গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ জানতে হবে। নিজে না জানলে অভিজ্ঞ কাউকে দিয়ে এ কাজ করাতে হবে। এর পরপর আসে টি-শার্ট প্রিন্টের কথা। আবদুল্লাহ আল আমিন জানান, এখন আমাদের দেশে দুই উপায়ে টি-শার্ট প্রিন্ট করা হয়। একটি হলো ম্যানুয়াল স্ক্রিন প্রিন্ট, অন্যটি হচ্ছে ডিজিটাল প্রিন্ট। তবে প্রচলিত বেশি ম্যানুয়াল স্ক্রিন প্রিন্ট। এতে খরচের মাত্রাটাও কম। যদিও বিভিন্ন স্থানে টি-শার্ট স্ক্রিন প্রিন্ট করানো হয়ে থাকে, তার পরও এ সম্পর্কে ধারণা ও বাস্তব জ্ঞান থাকতে হবে। তাহলে যেকোনো কারিগরি ত্রুটি ধরা সহজ হবে।
হবে পূর্ণাঙ্গ টি-শার্ট
টি-শার্ট তৈরির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেটিকে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হয়। এ জন্য টি-শার্টের মধ্যে বাড়তি কোনো সুতা থাকলে তা পরিষ্কার করতে হবে। এরপর স্টিম আয়রন করতে হবে। সঠিকভাবে ভাঁজ করে ফেলার পর ভাঁজ ঠিক রাখার জন্য শক্ত কাগজ দিয়ে দিতে হবে। টি-শার্টের গায়ে এর দাম ও ব্যবহারের নানা পরামর্শ উল্লেখ করতে পারেন। এরপর পলিব্যাগে করে বাজারজাত করা যাবে। 
দরকারি
টি-শার্টের ব্যবসা শুরুর আগে অবশ্যই একটি ট্রেড লাইসেন্স লাগবে। এরপর আয়কর কর্তৃপক্ষের আয়কর কোড ও আয়কর নিবন্ধন সনদ নিতে হবে। ব্যবসা শুরু করার দুই বছর পর এসব কাগজপত্র ঠিক থাকলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সহজেই ঋণসুবিধা নিতে পারবেন।
গড়ে তুলুন যোগাযোগ
টি-শার্টের ব্যবসা শুরু করার সময় অবশ্যই এটির প্রসারের বিষয়ে নজর দিতে হবে। একটি নান্দনিক নাম দিতে হবে টি-শার্টের। প্রথম দিকে নিজের পরিচিতদের দিয়ে এ ব্যবসা শুরু করতে পারেন। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টি-শার্টের দরকার হয়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সঠিক মান নিশ্চিত করতে পারলে আপনার ব্যবসার প্রসার হবে। নতুন ডিজাইন করা টি-শার্ট বাজারে আসার আগে দোকানে একটি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। ক্রেতাদের মন্তব্য নিয়েও এতে বৈচিত্র্য আনা যায়। ক্রেতাদের চাহিদা কেমন, এখান থেকেই ধারণা নিতে পারেন। তবে শুরুতেই কোনো দোকান দিতে না পারলেও বিভিন্ন পোশাকের দোকানে আপনার তৈরি টি-শার্ট সরবরাহ করতে পারেন।