বায়োগ্যাস প্লান্টের জন্য নতুন উদ্ভাবন ‘সেন্টার পাইপ’

দেশে বায়োগ্যাস পদ্ধতি চালু হয়েছে কয়েক বছর আগেই। এবার বায়োগ্যাস প্লান্টের ব্যবহার উপযোগী সেন্টার পাইপ উদ্ভাবন করল বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। এতে বছরে সাশ্রয় হবে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শাহ জামাল ও উপপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান সুজন বিস্তারিত জানিয়েছেন আমাদের জ্বালানি খরচ কমাতে রান্নার কাজে বায়োগ্যাস ব্যবহার লাভজনক। তবে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের পর এর পরিচর্যার ক্ষেত্রেও নিতে হয় কিছু পদক্ষেপ। বায়োগ্যাসের সেন্টার বা মাঝের যে পাইপটি দিয়ে রান্নার চুলায় গ্যাস সরবরাহ হয়, তা প্লান্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সম্প্রতি বায়োগ্যাস প্লান্টের সেন্টার পাইপ উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) অঙ্গ সংস্থা জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (আইএফআরডি)। উদ্ভাবনটি করা হয়েছে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায়। এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ শাহ জামাল ও উপপরিচালক ছিলেন এস এম আসাদুজ্জামান সুজন।

উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, বনসম্পদ রক্ষা, বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানো, রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূর ও কর্মসংস্থান বাড়ানোই ছিল এই উদ্ভাবনের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে আবাসভূমির তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় একদিকে যেমন বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে, তেমনি অতিরিক্ত দূষিত পদার্থ নির্গমনে হচ্ছে বায়ুদূষণ। পাশাপাশি প্রতিবছর প্রায় ১৫০ কোটি মণেরও বেশি খড়-বিচালি, লতা-পাতা, নাড়া-গোবর প্রভৃতি জমিতে পচতে না দিয়ে রান্নার জন্য চুলায় পোড়ানোর ফলে ভূমির উর্বরতা কমছে। এতে ফলনও কম হচ্ছে। আর কৃত্রিম রাসায়নিক সার ব্যবহারে ফসলে, মাটিতে এবং আমাদের শরীরে বাড়ছে বিষাক্ততাও। বাড়ছে রোগবালাই, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ছে দেশবাসী। এসব মিলিয়ে বায়োগ্যাস ও উন্নত চুলা সম্প্রসারণের কাজটি জরুরি হয়ে পড়ে।
প্রচলিত চুলার পরিবর্তে উন্নত চুলা ব্যবহারে বছরপ্রতি একটি চুলায় কমপক্ষে এক টন জ্বালানি অপচয় রোধ করা যায়। আর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন রোধ করা যায় প্রায় ০.৮ টন। অন্যদিকে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনে বিকল্প জ্বালানির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জৈব সারও পাওয়া যাচ্ছে বেশি। এতে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো সম্ভব।

নতুন সেন্টার পাইপের সুবিধা
বায়োগ্যাস প্লান্টে উৎপন্ন গ্যাস সেন্টার পাইপের মাধ্যমে চুলায় যায়। পুরনো লোহার পাইপ ক্ষয় হওয়া বা ফুটো হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। নতুন পিভিসি পাইপে এটা হয় না বললেই চলে। এ ছাড়া নতুন পিভিসি সেন্টার পাইপের ডায়ামিটার বড় হওয়ায় গ্যাস ব্লক হওয়ার আশঙ্কাও অনেক কম। পুরনো লোহার পাইপে গ্যাসের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রিডিউসার দরকার পড়ে, যা নতুন সেন্টার পাইপে লাগবে না। নতুন পিভিসি সেন্টার পাইপ নষ্ট হলেও তা বদলানো সহজ, অন্যদিকে পুরনো পাইপ বদলাতে গেলে পুরো প্লান্ট বন্ধ করে কংক্রিট ভেঙে বদলাতে হতো। অনেক সময় বাসার লোকজন দুই-তিন দিনের জন্য বাইরে কোথাও গেলে গ্যাসের প্রয়োজন হয় না। সে মুহূর্তে সেন্টার পাইপের সুইচের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা যায়।

পাইপ স্থাপনের পদ্ধতি
বায়োগ্যাস প্লান্টের সবচেয়ে ওপরের ডোমের মাঝ বরাবর সেন্টার পাইপটি বসাতে হয়। পাইপের নিচের অংশ কংক্রিট দিয়ে শক্ত করে আটকাতে হয়। এ পদ্ধতিতে দরকার একটি পিভিসি পাইপ, একটি বল বাল্ব, একটি হোস পাইপ নিপল, একটি জিআই সকেট ও তিনটি নির্দিষ্ট সাইজের রড। বায়োগ্যাস প্লান্টের আয়তন অনুযায়ী সেন্টার পাইপের আকার নির্ধারণ করতে হয়। যেমন- ৮০ থেকে ৫০০ সিএফটি বায়োগ্যাসের প্লান্টের জন্য ৪০ মিলিমিটার, ৫০০ থেকে ২০০০ সিএফটির জন্য ৬০ থকে ৭৫ মিলিমিটার এবং ২০০০-এর বেশি আকারের বায়োগ্যাস প্লান্টের জন্য দরকার ৭৫ থেকে ৮০ মিলিমিটারের সেন্টার পাইপ। একটি পিভিসি সেন্টার পাইপ বসাতে খরচ পড়ে আট শ থেকে এক হাজার টাকা।

বাস্তবায়ন
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বায়োগ্যাস ও উন্নত চুলা সম্প্রসারণের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস ও বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পটি ২০১১ সালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২০১৩-তে। এতে ব্যয় হয় ৯ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশের পাবনা, দিনাজপুর, কুমিল্লা, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব জেলায় মোট আটটি এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাতটি জেলায় সর্বমোট দুই হাজার ৮০০টি পারিবারিক বায়োগ্যাস প্লান্ট (তিন ঘনফুট) নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি বায়োগ্যাস প্লান্টের জন্য ১২ হাজার টাকা করে ভর্তুকি দেওয়া হয়। অন্যদিকে উন্নত চুলা স্থাপনের ক্ষেত্রে সাতটি জেলায় সর্বমোট ২৮ হাজারটি উন্নত চুলা স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিটি একমুখী উন্নত চুলা স্থাপনের জন্য ২০০ টাকা এবং প্রতিটি দ্বিমুখী উন্নত চুলা স্থাপনের জন্য ২৫০ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আটটি সেমিনার আয়োজন করা হয় এবং দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে ২৯টি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে ৩৫৬ জনকে।

সাফল্য
প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবেশ রক্ষায় সাত হাজার ৮০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাস পাচ্ছে, এক লাখ ৫৬ হাজার টন জ্বালানি সাশ্রয় হচ্ছে। সঙ্গে উৎপাদিত হচ্ছে ৫০ হাজার টন জৈব সার।


এস এম আসাদুজ্জামান সুজনের জন্ম ১৯৭৯ সালের ২১ এপ্রিল। তাঁর বাবা এস এম আনোয়ার হোসেন এবং মা হোসনে আরা বেগম। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ রমিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। আর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে করেন এইচএসসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত রসায়ন এবং রাসায়নিক প্রযুক্তিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর)। সেন্টার পাইপ ছাড়াও কাজ করেছেন জৈব জ্বালানি উৎপাদন বিকল্প জ্বালানি প্রকল্পে।