বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার
দ্বার নাজিরপুর (পিরোজপুর) প্রতিনিধি- কৃষি
প্রধান বাংলাদেশে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি নির্ভর খাদ্য
সমাগ্রীর চাষাবাদ করে অধিক ফলন পাওয়ার প্রচেষ্টা বহুদিনের। তবে সম্পূর্ণ স্থানীয়
প্রযুক্তিতে বিলাঞ্চলের পতিত জমির পানিতে ভাসমান পদ্ধতিতে কৃষি পণ্যের চারা উৎপাদন
ও চাষাবাদে সফলতা অর্জন করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে
পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার বিলাঞ্চলের কৃষকেরা। কোন প্রকার রাসায়নিক
সার ব্যবহার ছাড়াই স্থানীয়ভাবে তৈরী জৈব সার ব্যবহার করে ভাসমান পদ্ধতিতে অধিক ফলনশীল
কৃষি পণ্যের চারা উৎপাদন ও সবজি চাষের এ পদ্ধতিটি ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পিরোজপুরের
নাজিরপুর উপজেলার গন্ডি পেরিয়ে গোটা বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি গবেষকদের কাছে ।
সরেজমিন
ঘুরে দেখা গেছে, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল দেউলবাড়ী
দোবড়া ও মালিখালী ইউনিয়নের মুগারঝোর, কলারদোয়ানিয়া, দীর্ঘা, বৈঠাকাঠা, খলনি, মেদা, সাচিয়া, পাকুরিয়া, গাওখালী, পদ্মডুবি, বিল ডুমুরিয়া
সহ অনেক গ্রামের পতিত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে শাক সবজি ও তরকারির চারা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক
চাষাবাদ হচ্ছে। সম্পূর্ণ পানির উপর ভাসমানভাবে চাষাবাদ হয় বলে স্থানীয়ভাবে
এ চাষাবাদ প্রক্রিয়াকে ভাসমান পদ্ধতির চাষাবাদ বলা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র ভাসমান পদ্ধতির
চাষাবাদের কারণে গোটা বাংলাদেশে এক নামে পরিচিতি পেয়েছে পিরোজপুরের বিলাঞ্চল ।
এলাকাবাসী
ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে , বিল এলাকা হওয়ায় বছরের বেশীর ভাগ সময় উল্লে-খিত দুটি
ইউনিয়নের বেশীর ভাগ জমি পানিতে ডুবানো থাকে। এসব জমিতে সাভাবিকভাবে কোন ফসল চাষ করা
সম্ভব হয়না। বছরের পর বছর জুড়ে পতিত এ জমিতে কচুরিপানা, দুলালীবন, শ্যাওলা
ও ফেনা ঘাসে ভরা থাকে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় দুই যুগ পূর্বে স্থানীয় কৃষকেরা সম্মিলিত উদ্দ্যোগে জমির পানিতে
প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া কচুরিপানা, শ্যাওলা, দুলালীবন পচিয়ে সারি-সারি কান্দি (আইল) তৈরী করে তার
উপর ফসল চাষের চেষ্টা করে সফল হন। গোটা বিলাঞ্চলের
শত শত হেক্টর পতিত জমি এখন এ প্রক্রিয়ায় এসেছে চাষাবাদের আওতায়। প্রতি বছর নতুন
করে এ পদ্ধতির চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ, বাড়ছে
আবাদি জমির পরিমাণ। উপজেলার বিলাঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার পরিবার আজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে
জড়িত আছে ভাসমান পদ্ধতির আবাদের সাথে। এক সময়ের দুঃখ কষ্টের দিন ঘুরে আজ কৃষকের মুখেও
ফুটেছে আনন্দের হাসি। চলতি মৌসুমে উল্লেখিত বিল এলাকায় প্রায় ১ শত হেক্টর জমিতে বীজ তলায় চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছে আর ২ হাজার
হেক্টর জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে কান্দি (আইল) তৈরী করে প্রস্তুতি চলছে শাক-সবজি ও তরকারী আবাদের ।
যেভাবে চাষ হয়ঃ এ অঞ্চলের
ধানি জমিতে বাংলা বছরের অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বোরো ধানের চাষ হয়। এরপর
আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত সাত থেকে আট ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে এসব জমি।
তাই এ সময়টায় এখানকার মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।
দুই উপজেলার কয়েকটি গ্রাম বছরে প্রায় সাত থেকে আট মাস জলাবদ্ধ থাকে। জলাবদ্ধ পানিতে
জন্ম নেওয়া জলজ উদ্ভিদ, কচুরিপানা, শ্যাওলা, দুলালীলতা ভাসমান পদ্ধতিতে তৈরি জৈবসার এ পদ্ধতির প্রধান
উপকরণ। আষাঢ় মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা
এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, কচুরিপানা ও দুলালীলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু
ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। ধাপে জৈব উপকরণ দ্রুত পচাতে
ব্যবহার করা হয় সামান্য
পরিমাণ ইউরিয়া সার। একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার দীর্ঘ ও দেড় মিটার প্রশস্ত হয়।
সেসব ধাপ দ্রুত পচানোর জন্যও সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। এ ধাপ চাষের
উপযোগী করতে সাত থেকে ১০ দিন প্রক্রিয়াধীন রাখতে হয়। ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতিতে সরাসরি
বীজ বপন সম্ভব না হওয়ায় কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। তারা
এর নাম দিয়েছেন দৌল্লা। এক মুঠো করে টেপাপানা (ছোট কচুরিপানা), দুলালীলতার
মধ্যে নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দৌল্লা। শুধু নারীরাই দৌল্লা তৈরির
কাজ করেন। এ দৌল্লার মধ্যে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে মাচানে বা শুকনো জায়গায়
রাখা হয়। এর আগে ভেজা জায়গায় বীজ অঙ্কুরিত করা হয়। দৌল্লাগুলো এভাবে তিন থেকে সাত
দিন সারি করে রাখা হয়। ধাপে স্থানান্তরের পাঁচ-ছয় দিন পর গজানো চারার পরিচর্যা শুরু
হয়। পাঁচ-ছয় দিন পর পর ভাসমান ধাপের নিচের কচুরিপানার মূল বা শ্যাওলা দৌল্লার গোড়ায়
বিছিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই বীজ থেকে লাউ, কুমড়া, করলা, ঝিঙে, শিম, বরবটি, পেঁপে, বেগুন, বাঁধাকপি, টমেটো ও শসার চারা উৎপাদন করা হয়। একটি অঙ্কুর বীজতলায়
রোপণ করার ২০ থেকে ২২ দিনের মাথায় পূর্ণবয়স্ক চারায় রূপান্তরিত হয়। এক সপ্তাহের
মধ্যে কৃষক বা চারার পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান এসব চারা। জৈব সারে উৎপাদিত
এসব চারার উৎপাদন খরচ পড়ে এক থেকে দেড় টাকা। এক হাজার চারা দুই হাজার ৫০০ টাকা থেকে
তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শাক-সবজি বড় হলে চাষিরা ধাপ থেকে তুলে বিভিন্ন বাজারে
বিক্রি করেন। পুরনো ধাপ কিনে কৃষকরা এর ওপর কুমড়া, শিম, পেঁপে, করলা, টমেটো, লাউ, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক
বা সাদাশাকের চাষ করে থাকেন।
ধাপের পুনর্ব্যবহারঃ ধাপের মেয়াদকাল সাধারণত তিন মাস।
কিন্তু অঙ্কুর থেকে চারায় পরিণত হয় মাত্র ২০ থেকে ২২ দিনে। যে কারণে ধাপগুলো পুনরায়
ব্যবহার করার জন্য সামান্য পরিবর্তন করতে হয়। তখন ৫০ মিটারের একটি ধাপের জন্য দুই
হাজার থেকে দুই হাজার পাঁচ শ টাকা খরচ হয়। পুনরায় ধাপ প্রস্তুত না করে প্রথমবার ব্যবহৃত
ধাপ আবার অন্য কৃষকের কাছে বিক্রিও করে দেওয়া যায়, যা এখানকার কৃষকরা প্রায়
সময়ই করে থাকেন। প্রথমবার ব্যবহৃত ধাপ বিক্রি হয় দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায়।
আয়-ব্যয়ঃ প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মিটারের একটি সারি, দল বা ধাপ তৈরি করতে খরচ হয়
প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। এ ধরনের একটি ধাপ তৈরির জন্য একজন মানুষের ২৫০ টাকা মজুরি
হিসেবে ছয় দিন আট বা দশ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। ধাপের জন্য এক হাজার টাকার কচুরিপানা, এক হাজার
টাকার দুলালীলতা, এক হাজার টাকার টেপাপোনার দরকার হয়। এ জাতীয় চাষে একজন
কৃষক শুধু একটি বেড় থেকে প্রথম ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে আয় করেন দুই থেকে তিন হাজার
টাকা। প্রতি ৫০ মিটার লম্বা ও এক মিটার চওড়া একটি ধাপে ছয় ইঞ্চি দূরত্ব করে একটি
চারা রোপণ করলে একটি সারিতে মোট দুই হাজার ৪৫০টি চারা রোপণ করা যায়। প্রতি চারা পাইকারি
তিন টাকা বিক্রি করা হয়। তাই প্রতিটি সারির চারা বিক্রিতে প্রায় দুই হাজার থেকে তিন
হাজার টাকা লাভ থাকে।
কর্মসংস্থানঃ নাজিরপুর উপজেলার প্রায় এক হাজার নারী শ্রমিক এ
চারা উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। একজন নারী শ্রমিক প্রতিদিন গড়ে
২০০ টাকা আয় করেন। সরকারি বৈঠাকাটা কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ছালমা বলেন, কলেজের
ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দৌল্লা তৈরি করি। এ সময় আমি এক
হাজার থেকে এক হাজার ২০০ দৌল্লা তৈরি করতে পারি। এ জন্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পাই, যা আমার
পড়াশোনার কাজে ব্যয় করি। তাঁর মতো অনেক শিক্ষার্থী স্কুল বা কলেজ শেষে এ জাতীয় কাজ
করেন। আরেক শিক্ষার্থী আসলাম বলেন, জমিতে কাজ করে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করি।
কৃষকদের কথাঃ ঝড় ও জলোচ্ছ্ব্বাস এ পদ্ধতির চাষাবাদে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
তবে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে যেমনি রয়েছে সুবিধা, তেমনি রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা।
প্রধান সমস্যা সরকারি বীজের দোকান না থাকা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। এ ছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের
অধিক মুনাফা তো রয়েছেই। পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, অপর্যাপ্ত
প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, প্রয়োজন অনুসারে বীজতলা তৈরির জন্য সার না পাওয়া এবং
ঋণসুবিধা না থাকায় চাষিদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। নাজিরপুর উপজেলার মুগারঝোর গ্রামের
রফিকুল ইসলাম, রাসেল হাওলাদার, গাওখালীর বাচ্চু মৃধা, দেউলবাড়ি আজম শরীফসহ কয়েকজন
চাষি জানান, এক মৌসুমে চারা উৎপাদন ও বিক্রি করে একরে প্রায় ১০ হাজার
টাকা লাভ থাকে। পানিবেষ্টিত এ অঞ্চলে ধাপ পদ্ধতির চাষে জড়িত চাষিদের সহজশর্তে ঋণ দিলে
চাষাবাদের আরো বিস্তৃতি ঘটবে। মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। ওই সবজি চাষিরা আরো
জানান, কৃষকদের
অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বেশি লাভবান
হবেন। মুগারঝোর কৃষি উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক জলিল হাওলাদার বলেন, পণ্য পরিবহনের
জন্য উন্নত ব্যবস্থা চালুসহ এলাকায় একটি হিমাগার স্থাপনের দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের।
এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) একটি বীজ বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন
একান্ত জরুরি। পাশাপাশি কচুরিপানা সংকটের কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। তাই এ এলাকায়
কচুরিপানা চাষাবাদ করার কৌশল উদ্ভাবন প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, কৃষি বিভাগ
থেকে একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে সাধারণ চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
তবে তারা এখন পর্যন্ত সমাধানের পথ খুঁজে দেননি।
বিশেষজ্ঞদের কথাঃ নাজিরপুর উপজেলা কৃষি
কর্মকর্তা মোহাম্মদ রকিব উদ্দিন বলেন, ইতিহাস ঘেঁটে যতদূর সম্ভব জানা গেছে, নাজিরপুরের
কৃষকরাই প্রথম ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। তাও অন্তত দেড়’শ বছর হবে।
পর্যায়ক্রমে তা বানারীপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রক্রিয়া বরিশাল বিভাগ থেকে সিলেট, যশোর, মানিকগঞ্জ
ও সুনামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে এ পদ্ধতির চাষাবাদ আরো হওয়া প্রয়োজন।
তিনি সীমাবদ্ধের কথা স্বীকার করে বলেন, বীজ আর কচুরিপানাই চাষাবাদ পদ্ধতি বিস্তারে অন্তরায়।
এই দুটি বিষয় সুরাহা হলে পদ্ধতির আরো প্রসার ঘটবে।
0 comments:
মন্তব্য করুন